আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের চিকিৎসাসেবায় হেলাফেলা

1

খালেদ মনছুর, আনোয়ারা

আনোয়ারায় ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক সময় চিকিৎসক ও নার্স সংকটের কথা বলে চিকিকৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার দোহাই দিলেও বর্তমানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স থাকার পরও কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা মিলছে না বলে অভিযোগ করছেন সাধারণ রোগীরা। এজন্য ডাক্তার-নার্সদের কর্তব্যে অবহেলা ও হাসপাতালের চেয়েও প্রাইভেট চেম্বারকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. ফারজানা বিথি থাকেন না হাসপাতালের সরকারি কোয়ার্টারে। আবাসিক রোগীদের সকাল ও রাতে দিনে দুইবার ডাক্তার ভিজিটের কথা থাকলেও ডাক্তার ভিজিট করেন দিনে একবার। সকাল দশটায় আসার কথা থাকলেও আসেন এগারটায়। তাও আবার এক রোগীকে এক দুই মিনিটের বেশি দেখেন না। আরএমও এবং টিএইচও দুইজনই স্থানীয় শেভরণ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রাইভেট চেম্বার করেন। ডাক্তাররা আসেন দেরিতে আবার চলে যান দুপুর একটার পরপরই। হাসপাতালে আসা রোগীদের যেতে বলেন প্রাইভেট চেম্বারে। হাসপাতালে ওষুধ থাকা সত্তে¡ও অনেক চিকিৎসক তা দেন না রোগীদের। হাসপাতালের আবাসিক রোগীদের কক্ষগুলো ঠিকমত পরিষ্কার করা হয়না। সেখানে ঢুকলে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধে দম আটকে যায়। এক কথায় ভাল চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না আনোয়ারা উপজেলার ৫০ শয্যার হাসপাতালের রোগীরা। গত ৯ এপ্রিল দুপুরে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় ইফতেখার (১৩) নামের একজন শিশুর মৃত্য হলে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার এই দৈন্যদশা ফুটে উঠে। গত কয়েকদিনে সরেজমিন হাসপাতাল ঘুরে এবং রোগী ও রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার এই চিত্র দেখা যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, ডাক্তাররা বসেন এসি রুমে অন্যদিকে রোগীদের জোটেনা পাখার বাতাসও। করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেশ কয়েকটি এসি, পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন ও বৈদ্যুতিক পাখা অনুদান দেয় সমাজের বিত্তবানরা। এসব এসির মধ্যে একটি টিএইচওর রুমে, একটি আরএমওর রুমে, একটি স্টোররুমে, একটি ওটি রুমে স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এই গরমে হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে রোগীদের রুমের অনেক বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট দেখা গেছে। এছাড়া হাসপাতালের জেনারেটরটিও বিদ্যুৎ চলে গেলে ছাড়ে মাত্র একবার। তেল খরচের অজুহাতে জেনারেটর চালু না করে রোগীদের অন্ধকারে রাখা হয় বলে জানিয়েছেন রোগীরা।
হাসপাতালের ইসিজি মেশিনটি সব সময় পাওয়া যায়না। মেশিন পাওয়া গেলেও অপারেটর হাসানকে পাওয়া যায়না। বিকাল চারটায় অপারেটর হাসান চলে গেলে বন্ধ থাকে ইসিজি সেবা।
এসময় কোনো গুরুতর রোগী আসলে আশপাশের প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেই দৌড়াদৌড়ি করতে হয় রোগীর স্বজনদের। চাতরী ইউনিয়নের জামায়াত নেতা মো. জসীম বলেন, হাসপাতালের ইসিজি মেশিন না থাকায় রাতে পাশর্^বর্তী প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ঘুম থেকে তুলে এনে আমার চাচার ইসিজি করাতে হয়েছে। তাতে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় শেষমেষ আমার চাচা চমেক হাসপাতালে নিতে নিতে মারা গেছে।
জানা যায়, আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স্রে বর্তমানে ২৫ জন চিকিৎসক, ৩০ জন নার্স ও ৬২ জন কর্মচারী কর্মরত আছেন। একটি ৫০ শয্যার হাসপাতালের যা চিকিৎসক, নার্স দরকার তার বেশিরভাগই আছে হাসপাতালে। তারপরও চাহিদামত চিকিৎসাসেবা মিলছেনা বলে অভিযোগ রোগীদের। এজন্য চিকিৎসক নার্সদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা, স্বেচ্ছাচারিতা, ও কর্তৃপক্ষের অনিয়ম অব্যস্থাপনাকেই দায়ী করছেন রোগীরা।
অভিযোগ আছে, হাসপাতালের টিএইচও ও আরএমও দুইজনই স্থানীয় শেভরন ডায়ানস্টিক সেন্টারে প্রাইভেট রোগী দেখার ফলে এই প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে নিজেরাই সবকিছু পূরণ করে দেন। অন্য প্রতিষ্ঠানের মালিকরা যেখানে লাইসেন্স নবায়নের শর্ত পূরণে হিমশিম খেয়ে যায় সেখানে শেভরণ আনোয়ারা শাখাকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন অন্য প্রতিষ্ঠনগুলোর মালিকরা। এ প্রতিষ্ঠানের দোষ-ত্রæটি দেখেও না দেখার ভান করেন তারা।
এদিকে হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণ নার্স থাকার পরও তাদের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালে ভর্র্তি রোগীরা জানান, নার্সরা তাদের নির্ধারিত রুমে বসে থাকেন।
রোগীদের ইনজেকশান বা অন্য কোনো প্রয়োজনে তাদের রুমে যেতে বলেন। বেশিরভাগ সময়ই রোগীদের সুবিধা -অসুবিধা না দেখে রুমের মধ্যে আড্ডা দিতে দেখা যায়।
আন্তঃবিভাগে রোগীর স্বজন মো. রুবেল বলেন, গত ৯ এপ্রিল শিশু ইফতেখার যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল তখনও রুমের বাইরে বেশ কয়েকজন নার্স গল্প করছিল। তারা যদি দ্রæত অক্সিজেন লাইনটা যুক্ত কওে তাহলে শিশুটিকে বাঁচানো যেত।
তিনি আরো বলেন, শিশুটিকে যে সিটে ভর্তি করা হয়েছে তার উপরের পাখাটা এক সপ্তাহ ধরে নষ্ট। শিশুটিকে নেবুলাইজ করে ইনজেকশন দিয়ে সিটে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো অক্সিজেন দেওয়া হয়নি। শিশুটির যখন খিচুনি এসে যায় তখন নার্সরা মাসিকে ডাকাডাকি করে অক্সিজেন আনতে বলে। অন্য রুম থেকে অক্সিজেন আনতে আনতে সে মারা যায়।
আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আনোয়ারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার-নার্সদের সংখ্যা আগের তুলনায় ভাল। ডাক্তাররা যদি অফিস সময়ের পরে প্রাইভেট চেম্বার করে তাহলে সেখানে আমাদের করার কিছু নেই। তবে ডাক্তার-নার্সদের কর্তব্যে অবহেলার কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাহমিনা আকতার জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে তেমন যোগাযোগ করেননা। সুবিধা অসুবিধা আমাদের জানাতে হবে। কাজের চাপে আমরা নিজ থেকে খবরাখবর রাখতে পারিনা। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো সাহায্য চাইলে আমরা সবসময় প্রস্তুত। এর আগেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছু প্রকল্প চাইলে আমরা দ্রæত পাশ করে দিয়েছি। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন অফিসারের মোবাইল ফোনে কল দিলে রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।