আনোয়ারায় বেড়িবাঁধের জমি দখল করে মাছের ঘের

2

আনোয়ারা প্রতিনিধি

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় পারকি সমুদ্র সৈকত এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের জমি দখল করে গড়ে তোলা মাছের ঘের থেকে এস্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটছে প্রভাবশালীরা। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর অভিযান চালিয়ে প্রায় ১০ একর জমি উদ্ধার করেছে পাউবো।
সরেজমিনে গিয়ে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত ৩০ বছর ধরে স্থানীয় ও বহিরাগত প্রভাবশালীরা পারকি সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি খাস জমি দখলে রেখে করেছেন বিভিন্ন স্থাপনা ও বিনোদন পার্ক। অনেকে করেছেন মাছের ঘেরও। বিভিন্ন সময়ে তারাই সৈকতের বালু ও মাটি কেটে লুট করে বিক্রি করছে। চরে বন বিভাগের লাগানো ঝাউগাছ কর্তনসহ মৎস্য ঘেরের নামে দখলের প্রতিযোগিতায় ধ্বংস হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত পারকি। স্থানীয় ও বহিরাগত প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন পারকিকে পর্যটন এলাকা ঘোষণা করে নানা পরিকল্পনা ও বরাদ্দ দিলেও গত ৩০ বছরেও বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি পারকি সমুদ্র সৈকত। উল্টো সৈকত জুড়ে চলছে দখলে রাখা জমিতে এস্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটা ও বালু বিক্রির হিড়িক।
স্থানীয়রা জানান, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় যারা পারকি সৈকত এলাকায় সরকারি জায়গা দখল করে মাছের ঘের ও পর্যটন ব্যবসা চালিয়েছেন তারা অনেকে আত্মগোপনে থেকে এখনো ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অনেকে আবার বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে আঁতাত করে যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। মাছের ঘের তৈরির জন্য পারকি সমুদ্র সৈকতে বিভিন্ন সময়ে বাঁধ কাটার ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করতে হচ্ছে পাথরের আরেকটি বাঁধ।
জানা যায়, আনোয়ারা উপকূলকে রক্ষায় বনবিভাগ ১৯৯৩-৯৪ সালে পারকি সমুদ্র সৈকত ও আশেপাশের প্রায় ৮০ হেক্টর জায়গায় ঝাউগাছ রোপণ করে। আর্কিটেকচারাল পদ্ধতিতে লাগানো এ গাছ বড় হয়ে উঠলে পারকি পর্যটন এলাকা হিসাবে রূপ লাভ করে। পারকির ঝাউবনে বসে একসঙ্গে বহির্নোঙরের জাহাজের সারি এবং সৈকতের লাল কাঁকড়ার দৃশ্য উপভোগের সুযোগ পান পর্যটকরা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল চালুর পর পারকির আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে বহুগুণে বেড়ে যায়। এছাড়াও সৈকতের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে টানেল সার্ভিস এরিয়া নামে আধুনিক ভবন ও বিনোদন কেন্দ্র। এখানে ভিআইপি হোটেল, মিলনায়তন ও বিনোদন কেন্দ্রসহ অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা রয়েছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে টানেল হয়ে মাত্র ৩ মিনিটে সৈকতে আসার ফলে পর্যটকদের কাছে এই অঞ্চলটির গুরুত্ব বেড়েছে।
সরকার ও পর্যটন কর্পোরেশন পারকি সমুদ্র সৈকতকে আধুনিক পর্যটন এলাকায় পরিণত করতে বিগত ৩০ বছর ধরে পরিকল্পনা ও কোটি টাকার বরাদ্দের শেষ রাখেনি। কিন্তু এসব পরিকল্পনা ও বরাদ্দে পারকি সৈকতে উন্নয়নের ছোঁয়া স্পর্শ করেনি অবৈধ দখলদারদের কারণে। উল্টো উন্নয়ন আর পরিকল্পনার কথা শুনে প্রভাবশালীরা দ্বিগুণ গতিতে নেমেছে দখলে। রাত হলেই চলে সৈকতের বালু উত্তোলন, খাস জমির মাটি খননের ডাম্পার গাড়ির অতিষ্ঠে নষ্ট হচ্ছে সড়কও।
স্থানীয় ও পর্যটকদের অভিযোগ, কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের ক‚ল ঘেঁষে অবস্থিত পারকি সমুদ্র সৈকতের জনপ্রিয়তা দিন দিন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লেও দৃশ্যমান কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বিগত দিনগুলোতে। সন্ধ্যার পরই নিরাপত্তাহীনতায় সৈকত ছাড়েন পর্যটকরা। সড়কেও নেই কোনো বাতির ব্যবস্থা। ছিনতাইয়ের শিকার হন সৈকতের আসা পর্যটকরা।
জানা গেছে, সৈকতের বেড়িবাঁধ ফুলতলী মৌজার ৫২৯ দাগে প্রায় সাড়ে ১০ একর জায়গা জুড়ে পানি চলাচলের জন্য একটি জলাধার ছিল। এ জলাধারটি ফুলতলী থেকে পারকি খালে এসে মিলিত হয়। এ জায়গার মালিকানা পানি উন্নয়ন বোর্ডের। ভ‚মি অফিসের খাতায় জলাধার থাকলেও সরেজমিনে গিয়ে জলাধারের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। জলাধারের জমিতে এখন গড়ে উঠেছে প্রভাবশালীদের বিনোদন পার্ক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সৈকতের রিং বাঁধ কেটে মৎস্য ঘেরের পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করার কারণে সৈকতের বালু ও ঝাউগাছের ব্যাপক ক্ষতিসহ পারকি সমুদ্র সৈকত লন্ডভন্ড হয়েছে। যার কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নতুন করে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হয়েছে।
চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, ‘পারকি সৈকতে অবৈধ দখলে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ১০ একর জমি উদ্ধার করে সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব জমি উদ্ধার করে দখল মুক্ত করা হবে এবং মাটি কেটে ক্ষতিসাধনের অভিযোগে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।