নিজস্ব প্রতিবেদক
আনন্দ, উচ্ছ্বাস, কবিতা, নৃত্য, শোভাযাত্রা, গান ও সুরের মুর্ছনাসহ নানা আয়োজনে চট্টগ্রামে বাংলা নববর্ষকে বরণ করেছে সর্বস্তরের হাজারো মানুষ। প্রখর রোদ উপেক্ষা করে গত সোমবার বাঙালির প্রাণের উৎসবে জেগেছিল নগরী।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পহেলা বৈশাখের নানা আয়োজন সম্পর্কে জানা যায়, বর্ষবরণের আয়োজন থেকে মুক্ত বাংলাদেশে বাঙালির চিরায়ত সাংস্কৃতিক চেতনা ধারণ করে বিভেদ-বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ডাক দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে এবার বর্ষবরণের বড় আসর বসে সিআরবি’র শিরিষতলায়। নগরীর ডিসি হিলে গত ৪৬ বছর ধরে বড় আয়োজন হয়ে আসছিল। কিন্তু গত রবিবার রাতে মঞ্চে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় সেই আয়োজন বাতিল করা হয়। এরপরও চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ আরও বিভিন্নস্থানে বর্ণিল উৎসব হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের বের করা শোভাযাত্রা প্রাণময় হয়ে ওঠে পহেলা বৈশাখের আয়োজন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে নতুনভাবে চট্টগ্রাম শহর গড়ার অঙ্গীকারে সবাইকে একসাথে কাজ করার আহবান জানিয়েছেন।
সোমবার সকালে অপর্ণাচরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে আয়োজিত বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নেন মেয়র ডা. শাহাদাত। এছাড়া আরও অংশ নেন সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। শোভাযাত্রাটি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ হয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
শোভাযাত্রায় উপস্থিত সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে মেয়র বলেন, “নতুন বছর হোক নতুনভাবে শহরকে গড়ার অনুপ্রেরণার। সবাই মিলে একটি ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি চট্টগ্রাম গড়বো। এজন্য নগরবাসীর সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। চট্টগ্রাম শুধু একটি শহর নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য একটি স্বপ্নের নগরী। একে গড়তে হলে প্রত্যেকেরই দায়িত্ব নিতে হবে।”
শোভাযাত্রাটি পুরো এলাকাকে আনন্দ ও উৎসবমুখর করে তোলে, আর নগরবাসীর মধ্যে একটি নতুন আশার বার্তা পৌঁছে দেয়। র্যালিতে অংশ নেন চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা ড. কিসিঞ্জার চাকমা, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, শিক্ষা কর্মকর্তা মোছাম্মৎ রাশেদা আক্তার, অপর্ণাচরণ স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবু তালেব বেলাল, সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশিদ।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের আয়োজনে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সভাপতিত্বে ও চান্দগাঁও ভূমি সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইউসুফ হাসানের সঞ্চালনায় পহেলা বৈশাখের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) ওয়াহিদুল হক চৌধুরী ও সিএমপির উপ-কমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি) নেছার উদ্দিন আহমেদ।
প্রথমেই দলগতভাবে জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং পরবর্তীতে পহেলা বৈশাখের আগমন উপলক্ষে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়। পহেলা বৈশাখের বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। অনুষ্ঠানে জেলা শিশু একাডেমিতে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধান অতিথিসহ অতিথিরা।বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন তাঁর পুরনো দিনের নববর্ষ উদযাপনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, নতুন প্রজন্ম যাতে হৃদয়ের আনন্দে নববর্ষ উদযাপন করতে পারে, সে পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। নববর্ষের দিনটি সকলের কাছে আনন্দের বিষয় হয়ে থাকুক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, পহেলা বৈশাখ এমন একটা অনুষ্ঠান, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি বজায় থাকে। আনন্দ শোভাযাত্রার মাধ্যমে এ অনুষ্ঠানে সকলের উপস্থিতি প্রমাণ করে পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। তাই পুরনো বছরের দৈন্যতা, গ্লানি মুছে দিয়ে নতুন বছরকে নতুনভাবে সাজিয়ে আমরা সকলে মিলে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ করবো।
এছাড়া বক্তব্য রাখেন জেলা আনসার-ভিডিপি কমান্ডার মো. আবু সোলায়মান ও জেলা মহিলা বিষয়ক উপ-পরিচালক আতিয়া চৌধুরী। শেষে অনুষ্ঠান মঞ্চে দলীয় সংগীত ও দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন চট্টগ্রাম জেলা শিশু একাডেমি ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিক্ষার্থীরা।
একইভাবে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা, উৎসব এবং জাঁকজমক আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বৈশাখী উৎসব। সকাল থেকে শুরু হয়ে দুপুরের মধ্যাহ্নভোজের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রামবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বাংলার সংস্কৃতি যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে এর ইতিবাচক দিকসমূহ সকলের কাছে তুলে ধরতে হবে। নগরীকে পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে পরিণত করতে হবে। এই শহর আমার আপনার সকলের। চট্টগ্রাম নগরীকে বাসযোগ্য এবং সুন্দর নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে গণমাধ্যমকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। নগরীর উন্নয়নে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে মহানগর বিএনপি’র আহব্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভাইস চেয়ারম্যান সাঈদ আল নোমানসহ অতিথিরা তাদের বক্তব্যে চট্টগ্রামে কর্মরত সকল গণমাধ্যমকর্মীদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান।
এ সময় তারা বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে একটি বৈষম্যহীন সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গণমাধ্যমর্কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
প্রেস ক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর পর আমরা চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সকলের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে পারছি। এটা আনন্দের। তিনি কষ্ট করে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হওয়ার জন্য অতিথিদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব সকলের জন্য উন্মুক্ত। সকল সদস্যকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আহবান জানান।
উপস্থিত অতিথি এবং সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, বাংলাদেশ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের স¤প্রীতির দেশ। এখানে বাঙালির সংস্কৃতিকে লালন করা হয়।
বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য মুস্তফা নঈম এবং গোলাম মাওলা মুরাদ, ওয়াহিদ জামান, হাসান মুকুল, মোহাম্মদ আলী, মুহাম্মদ আজাদ, শান্তনু বিশ্বাস, জাহাঙ্গীর আলম। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি নাজিমউদ্দিন, বিএমএ’র সাবেক সভাপতি ডা. খুরশীদ জামিল, বীর মুক্তিযোদ্ধা একরামুল করিম, রোটারিয়ান জসীম উদ্দিন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইকবাল শিকদার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রেস ক্লাবের সদস্য শাহনেওয়াজ রিটন। সঞ্চালনা করেন সোহাগ কুমার বিশ্বাস ও ফারুক মুনির।
অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফরিদা করিম, মিরাক্কেল তারকা আরমান, ফাহমিদা ইয়াসমিন, প্রিয়াংকা, অপূর্ব বড়ুয়া, অনামিকা’সহ ডজন খানেক সংগীত শিল্পী। আবৃত্তি শিল্পী মোস্তাক খন্দকার আবৃত্তি পরিবেশন করেন। মুকাভিনয় করেন কর্ণফুলী থিয়েটার। বৃন্দাবৃত্তি পরিবেশন করেন শব্দচারী আবৃত্তি অঙ্গন।
অপরদিকে নগরীর সিআরবির শিরিষতলায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সপ্তদশ আয়োজন শুরু হয় সোমবার সকাল ৭টায় ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে। ‘নববর্ষ উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রামের’ উদ্যোগে দিনব্যাপী এই আয়োজনে উদীচী চট্টগ্রাম, সঙ্গীত ভবন, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ রেলওয়ে সাংস্কৃতিক ফোরাম, স্বরলিপি সাংস্কৃতিক ফোরাম, সৃজামী, অদিতি সঙ্গীত নিকেতনসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা সম্মিলিত গান পরিবেশন করেন। এছাড়া বোধন আবৃত্তি পরিষদ, শব্দনোঙ্গর, তারুণ্যের উচ্ছ¡াসসহ কয়েকটি সংগঠনের শিল্পীরা বৃন্দআবৃত্তি পরিবেশন করেন। ওড়িষি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, নৃত্যনীড়, রাগেশ্রীসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন।
নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ফারুক তাহের বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। সকল মত-পথের ঊর্ধ্বে উঠে এদিনটি আমাদের এক হয়ে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরার প্রেরণা দেয়। আমরা একেকজন একেক ধর্মের অনুসারী হতে পারি। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, পৌষপার্বণ, নবান্ন এগুলো আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতি।’
উল্লেখ্য, সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে নগরীর বাদশা মিয়া সড়কের ক্যাম্পাস থেকে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা বের হয়। বাদশা মিয়া সড়ক থেকে আলমাস মোড়, কাজীর দেউড়ি, জামালখান হয়ে সার্সন রোড দিয়ে শোভাযাত্রা আবার চারুকলা ক্যাম্পাসে গিয়ে শেষ হয়। শিক্ষার্থীদের তৈরি জাতীয় মাছ ইলিশ এবং টেপা পুতুলের ঘোড়ার মোটিফ স্থান পায় ঢোল-বাদ্যের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া শোভাযাত্রায়। মুখোশ হিসেবে ছিল বাঘ, মহিষ ও খরগোশ।
শোভাযাত্রাকে ঘিরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন হয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের আশপাশজুড়ে। শোভাযাত্রা যে পথে গেছে সেখানেও পুলিশের কড়া প্রহরা দেখা গেছে।