আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে সচেতনতা বৃদ্ধি

1

ডা. নিশাত পারভীন

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১১ জন মানুষের বসবাস। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক চাহিদাপূরণে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রাচুর্যের অভাব রয়েছে। এছাড়া প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে প্রায় ত্রিশ লক্ষাধিক। যার প্রভাব পড়ছে বসতভিটা, চাষযোগ্য জমি, খাদ্য, পরিবেশ, বনজ ও খনিজসম্পদের ওপর।
আশঙ্কার বিষয় হলো, অর্থনৈতিক কারণে দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে জনঘনত্ব বাড়ছে অত্যন্ত দ্রæতগতিেিত। সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদেন অনুযায়ী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লাসহ বেশ কয়েকটি নগর এবং শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ অত্যধিক। রাজধানী ঢাকা শহরেই প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বসবাস করেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। এই বাড়ন্ত জনঘনত্বের কারণে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে জনগণের ন্যূনতম নাগরিকসেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জনঘনত্ব কমাতে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রসঙ্গ সবার আগে আসে তা হলো পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ। তবে পরিবার পরিকল্পনাকে এখন কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পন্থা হিসাবে দেখার উপায় নেই। একজন মায়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে প্রথমবার সন্তান প্রসবের পর দ্বিতীবার গর্ভধারণের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ বৎসরের বিরতি বা বিশ্রাম, অপুষ্টি থেকে রক্ষা ও সন্তানপ্রসবে প্রয়োজনীয় শারীরিক শক্তির পুনঃসঞ্চয়, গর্ভধারনের জটিলতা কমিয়ে মাতৃমৃত্যুঝুঁকি কমাতে ২০ বছরের নিচে এবং ৩৫ বছরের উপরের বয়সী মহিলাদের অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণরোধ করতে পরিবার পরিকল্পনা অতীব প্রয়োজন।
দেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে বাধামুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করি। সেক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা জরুরি , কারণ পরিকল্পিত গর্ভধারণ একজন নারীর বাড়ির বাইরে যোগাযোগ, অর্থনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে একটি পরিবার হবে স্বাবলম্বী।
কিন্তু অজ্ঞতা, অশিক্ষা. কুসংস্কার, সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যান্য কারণে এদেশে পরিবার পরিকল্পনার প্রচারণা, বিশেষ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের অনুমোদিত পদ্ধতির ব্যবহার এখনও প্রতিবন্ধতার সম্মখীন হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বিবাহিত দম্পতির মধ্যে প্রায় অর্ধেক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করেন না।
জন্মবিরতিকরণ খাবার বড়ি, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন, কপার টি, লাইগেশন, চামড়ার নিচে বসিয়ে দেয়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুল, কনডম, এবং এনএসভি পুরুষের জন্য। তবে অনেক পুরুষ এসব ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে নারীরা কুসংস্কারে এবং পারিবারিক ও সামাজিক চাপে আচ্ছন্ন থেকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করতে দ্বিধায় ভোগেন। অনেকে পরিবার পরিকল্পনাকর্মীর পরামর্শ না মেনে যেনতেনভাবে পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে গিয়ে পাশর্^প্রতিক্রিয়ার শিকার হন। এবং জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
পরিবার পরিকল্পনায় স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সমান অংশগ্রহণ আবশ্যক। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েদেও সংখ্যা বেশি, কেননা তাদেও নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম। এমন পরিবারের জন্য প্রয়োজন পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত সুপরামর্শ ও উপকরণের সহজলভ্যতা।
আশার কথা, দেশে পরিবার পরিকল্পনার ধারণাকে জনপ্রিয় করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এগিয়ে এসেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট এবং আরবান প্রাইমার হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট-এর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ধারাবাহিকতায় দেশের ১১টি সিটি করপোরেশন এবং ১৮টি পৌরসভা এলাকায় ১৫ থেকে ৪৯ বয়সী দম্পতিদের, বিশেষ করে যারা অতিদরিদ্র বা স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী, তাদের আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় রংধনু-চিহ্নিত ৪৫টি মাতৃসদন, ১৬৭টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৩৩৪টি স্যাটেলাইট ক্লিনিকে উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন এবং দক্ষ সেবাপ্রদানকারীগণ পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত পরামর্শ ও উপকরণের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজে এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। প্রকল্পভুক্ত প্রায় ৭০ শতাংশ উপযুক্ত বিবাহিত দম্পতি বর্তমানে আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন যেখানে জাতয়ি পর্যায়ে এই হার ৫৪ শতাংশের কাছাকাছি।
দেশে মোট প্রজননহার ২ শতাংশে নামিয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও মাতৃস্বাস্থ্য নিরাপদ করার উদ্দেশ্যে প্রকল্পের যে উদ্যোগ তা সফল করতে তথা সমাজে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার সুবিধা সম্পর্কে অবগত করতে সমাজের সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও প্রোগ্রাম অফিসার
আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্টÑ ২য় পর্যায়