‘আধুনিক চট্টগ্রামের’ নকশা চূড়ান্তের পথে সিডিএ

4

এম এ হোসাইন

চট্টগ্রাম নগরীর টেকসই, পরিকল্পিত ও আধুনিক উন্নয়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বর্তমানে একটি নতুন মাস্টারপ্ল্যানের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সিডিএ’র আওতায় সরকারের অর্থায়নে গৃহীত এই পরিকল্পনা নিয়ে নাগরিক সমাজের যেমন আগ্রহ, তেমনি প্রশ্ন ও প্রত্যাশাও ক্রমেই বাড়ছে। নতুন মাস্টারপ্ল্যানকে ঘিরে নগরবাসীর প্রত্যাশা, এটি যেন কেবল প্রেজেন্টেশনেই সীমাবদ্ধ না থাকে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাস্তবিক পরিবর্তন আসুক নগর অবকাঠামোতে।
সিডিএ’র উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এবং মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রকৌশলী আবু ঈসা আনসারী জানিয়েছেন, ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ কনসেপ্টের আলোকে নতুন মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে। মূল শহরের ওপর চাপ কমিয়ে বিকল্প শহর গড়ে তোলা, সেবা সংস্থাগুলোর জন্য নির্দিষ্ট বাস্তবায়ন নির্দেশনা, কৃষিজমি সংরক্ষণ এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করা হবে। এরপর সেক্টরভিত্তিক স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে গণশুনানির আয়োজন করা হবে যাতে সবার মতামতের প্রতিফলন ঘটে।
তবে এ উদ্যোগকে ঘিরে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। ১৯৯৫ সালে প্রণীত প্রথম মাস্টারপ্ল্যানে ১২টি জোন চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ জোন উপেক্ষিতই থেকে যায়। ২০০৮ সালে ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)’ তৈরি হলেও তারও বাস্তব প্রয়োগ সীমিত ছিল। এসব পরিকল্পনায় চট্টগ্রাম নগর ছাড়াও হাটহাজারী, বোয়ালখালী, মদুনাঘাট, পটিয়া ও আনোয়ারা অঞ্চলের উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এর বেশিরভাগই বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।
সিডিএ’র পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে যে, নতুন মাস্টারপ্ল্যান হবে বাস্তবভিত্তিক, পরিবেশবান্ধব, টেকসই এবং নাগরিকবান্ধব।
সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম জানিয়েছেন, এই মাস্টারপ্ল্যান হবে সকল স্টেকহোল্ডার ও জনগণের মতামতের সমন্বয়ে একটি আধুনিক চট্টগ্রামের নকশা। আমরা এটি বাস্তবায়নের জন্যই তৈরি করছি, ঘোষণার জন্য নয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসা ২০১৭ সালে ‘ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান’ তৈরি করেছিল। যা সিডিএ’র আগের প্ল্যান অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হয়। ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. মাকসুদ আলম জানিয়েছেন, আমাদের মাস্টারপ্ল্যানের কপি আমরা সিডিএকে দিয়েছি। ফলে নতুন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কোনো দ্ব›দ্ব বা সমন্বয়ের ঘাটতি থাকার কথা নয়। তবে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে বাস্তবসম্মত সমন্বয় ছাড়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। নগরবাসীর প্রত্যাশা এই মাস্টারপ্ল্যান যেন অতীতের মতো অনন্ত প্রতিশ্রুতির নামে বিশাল বাজেটের কাগুজে কাহিনী না হয়। তারা চান, এই পরিকল্পনা যেন সত্যিকার অর্থে নগরের ভবিষ্যৎ গঠনের রূপরেখা হয়, যা সময়মতো বাস্তবায়িত হবে এবং এর জন্য সুস্পষ্ট জবাবদিহিতা থাকবে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, যে পরিকল্পনার ভিত্তিতে বিপুল টাকা ব্যয় হয়, সেটি যদি বাস্তবে কাজ না করে, তবে তা জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। ৯৫ ও ২০০৮ সালের মাস্টারপ্ল্যান কী পরিমাণ বাস্তবায়ন হয়েছে, কী হয়নি, কেন হয়নি, এই মূল্যায়ন ছাড়া নতুন মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণযোগ্য হবে না।
তিনি বলেন, নগর পরিকল্পনায় জবাবদিহিতা না থাকলে এসব মাস্টারপ্ল্যান হয় লোক দেখানো, নয়তো স্রেফ কাগজে লেখা স্লোগান। নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে পুরনো পরিকল্পনার সাফল্য ও ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করেই এগোতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, যেকোনো আধুনিক শহরের ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ১৬ বছর পরপর মাস্টারপ্ল্যান হালনাগাদ করা অত্যন্ত জরুরি। তবে চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণের পরও সময়মতো আপডেট না হওয়ায় এবং বাস্তবায়ন না হওয়ায় শহরটি পরিকল্পনাহীনভাবে স¤প্রসারিত হয়েছে। ফলশ্রæতিতে জলাবদ্ধতা, ট্রাফিক জট, অপরিকল্পিত হাউজিং, কৃষিজমি দখলসহ নাগরিক দুর্ভোগ বেড়েছে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত সময় আছে। এরমধ্যে কয়েকটি মিটিং হয়েছে, সেখানে মাস্টারপ্ল্যানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন চূড়ান্ত খসড়ার উপর এলাকাভিত্তিক গণশুনানির আয়োজন করা হবে। সেখান থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো নেয়া হবে। সর্বশেষ চূড়ান্ত মাস্টারপ্ল্যান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় গেজেট আকারে এটি প্রকাশ করবে।