পূর্বদেশ ডেস্ক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাপক রদবদলের মধ্যে ঢাকাসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়র, ৪৯৩টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ৬০টি জেলার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের ৯৮৮ জন ভাইস চেয়ারম্যান ও ৩২৩টি পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার এ বিষয়ে পৃথক আদেশ জারি করা হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ -এর খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পরে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়।
ওই সংশোধনীর ফলে বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে সরকার জনস্বার্থে কোনো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র এবং কাউন্সিলরকে অপসারণ করতে পারবে। একইভাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করতে পারবে। একই সঙ্গে এগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে সরকার।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই লাপাত্তা ছিলেন বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের মেয়ররা। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ছাড়া বাকিদের কেউ গোপনে দেশ ছাড়েন, কেউ আত্মগোপনে চলে যান। দেখা মেলেনি প্যানেল মেয়রদেরও। এ পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের কাজে দেখা দেয় স্থবিরতা।
কেবল সিটি করপোরেশন নয়, পৌরসভা থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পরিষদেও দেখা গেছে একই চিত্র। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন সেবাদান নিশ্চিত করতে ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলমান রাখতে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু বিদ্যমান আইনে সেটি সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে সিটি করপোরশন আইন, পৌরসভা আইন, জেলা পরিষদ আইন ও উপজেলা পরিষদ আইনে সংশোধনী আনতে হয়েছে সরকারকে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী দেশের ১২ সিটি করপোরেশনে প্রশাসকরাই মেয়রের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন। এতে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এর ২৫ (ক) এর উপধারা (১) প্রয়োগ করে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত ১২ কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শের আলীকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক মাহমুদুল হাসানকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, খুলনার বিভাগীয় কমিশনারকে খুলনা সিটি করপোরেশন, রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনারকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারকে সিলেট সিটি করপোরেশন, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে বরিশাল সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ পলী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) মহাপরিচালককে (অতিরিক্ত সচিব) কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, রংপুরের বিভাগীয় কমিশনারকে রংপুর সিটি করপোরেশন, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন প্রশাসক করা হয়েছে।
নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে তারা এ দায়িত্ব পালন করবেন এবং বিধি মোতাবেক দায়িত্ব ভাতা প্রাপ্য হবেন। এছাড়া অন্য কোনো আর্থিক বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য হবেন না।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ- ২০২৪ এর ধারা ১৩(ঘ) প্রয়োগ করে বাংলাদেশের ৪৯৩টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে স্ব-স্ব পদ হতে অপসারণ করা হলো। অপসারণকৃত চেয়ারম্যানদের স্থলে সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করবেন।
এদিকে, পৃথক এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপজেলা চেয়ারম্যানদের অপসারণ ও মৃত্যুর কারণে চেয়ারম্যানের মোট শূন্য পদ ধরে মোট ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ১৭ আগস্ট ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এর খসড়া অনুমোদন করে অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এতে বিশেষ পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যানকে অপসারণের বিধান রাখা হয়। পরে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়।
এদিকে, অপর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশের ৬০টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়। এছাড়াও পৃথক প্রজ্ঞাপনে, পার্বত্য তিন জেলা বাদে দেশের ৬১টি জেলায় প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মৃত্যুর কারণে নাটোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হয়েছে। আটটি জেলা পরিষদে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (সার্বিক) এবং ৫৩টি জেলা পরিষদে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব কর্মকর্তা নিজ নিজ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন।
অপর এক আদেশে দেশের ৩২৩টি পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করা হয়। দেশের সাতটি উপজেলায় আগে থেকেই যে ৭ জন প্রশাসক নিয়োগ করা ছিল, তাদেরকেও অপসারণ করা হয়। এছাড়া পৃথক আদেশে দেশের ৩৩০টি পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে।
এদিকে পৌরসভাগুলোতে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকদের। কোথাও কোথাও সহকারী কমিশনারদেরও (ভূমি) পৌরসভার প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে সারাদেশের উপজেলা পরিষদের ৯৮৮ জন ভাইস চেয়ারম্যানকে অপসারণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর মধ্যে ৪৯৪ জন পুরুষ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ৪৯৪ জন। গতকাল স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এর ধারা ১৩ঘ প্রয়োগ করে এসব ভাইস চেয়ারম্যান ও সব মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানকে উপজেলা পরিষদের স্ব স্ব পদ থেকে অপসারণ করা হলো।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে গেছেন। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। পরে বিকল্প ব্যবস্থা করে সরকার। যেমন উপজেলা চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন সংশোধন করে মেয়র-চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ তৈরি করছে সরকার।