ড. রাহমান নাসির উদ্দিন
প্রতিবছর আগস্ট মাসের ৯ তারিখ International Day of the WorldÕs Indigenous Peoples যা বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। অবশ্য বাংলাদেশে এ দিবস পালিত হয় বেসরকারিভাবে, কেননা বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’রা সাংবিধানিক কাঠামোর পরিভাষায় আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু প্রতিবছর আগস্ট মাসের ৯ তারিখ বিশ্বব্যাপী পৃথিবীর প্রায় নব্বইটি দেশে ৩৭০ মিলিয়ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী দিবসকে উপলক্ষ করে নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি উপস্থাপনের পাশাপাশি তাদের নানান দাবি-দাওয়া নিজ নিজ রাষ্ট্রের সামনে এবং বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। ফলে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস কেবল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপনের দিন নয়, বরং বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে নিজেদের বহুমাত্রিক বঞ্চনা, নির্যাতন, শোষণ এবং নিপীড়নের আলেখ্য তারা নিজ নিজ রাষ্ট্রের সামনে এবং বিশ্ব সমাজের সামনে উপস্থাপন করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী আদিবাসীর সংখ্যা সারা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫ ভাগ এবং পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ ভাগ। এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রায় ৭ হাজার ভাষায় কথা বলে এবং এদের রয়েছে প্রায় ৫ হাজার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। আমি পত্রিকান্তরে লিখেছিলাম, ‘ঐতিহাসিকভাবে নানান শোষণ, দখলদারিত্ব, নিপীড়ন এবং বঞ্চনার ভেতর দিয়ে দিন গোজার করেও এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীই আজকের পৃথিবীটাকে করে তুলেছে বহু-বৈচিত্র্যময় এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের এক সুন্দর আবাসভূমি। অথচ এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী আজও পৃথিবীর নানান দেশে দেশে নানান মাত্রায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রান্তিকায়নের শিকার।’
এ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অধিকার দেখভাল এবং এ বিশাল ভাষাগোষ্ঠী এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সংরক্ষণের তাগিদ থেকেই ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবছর ৯ আগস্ট বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সত্যিকার অর্থে তখন থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উদযাপন করে আসছে। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে একটা ঘোষণা দেয়, যাতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সেটা সমানে রেখে এ দিবস পালন করে।
প্রতি বছর আগস্টের ৯ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতিসংঘ একটি মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দেয়। এ বছরও তার অন্যথা হয়নি। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে Protecting the Rights of Indigenous Peoples in Voluntary Isolation and Initial Contact, যার বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ‘আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেদের অধিকতর শামিল করুন’। এখানে লেখা বাহুল্য যে প্রতিবছর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের’ ঘোষণাকে মূল ভিত্তি রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে নিজস্ব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের মতো করে একটি ‘ডাক’ নির্ধারণ করার জন্য পুনঃশব্দায়ন করা হয়।
কেননা, ল্যাটিন আমেরিকার আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা কিংবা আফ্রিকার নানান দেশের আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা এক নয়। ফলে, জাতিসংঘ ঘোষিত মূল থিমকে অটুট রেখে স্থানিক পরিপ্রেক্ষিতকে অন্তর্ভুক্ত করে সামান্য পুনঃশব্দায়ন করা হয়। তাই, বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় আজকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের ঘোষণা তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিদ্যমান এবং চলমান অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আরও অধিকতর সম্পৃক্তকরণের ডাক।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে। আদিবাসী গোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫৪টি এবং এদের বেশির ভাগই নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। এ দেশের প্রগতিশীল, সংবেদনশীল এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে বিশ্বাসী মানুষ সারা দেশে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ পালন করছে। আজ বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পার্বত্য জেলায় আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। এসব অনুষ্ঠানে বহু বৈচিত্র্যময় আদিবাসী সংস্কৃতি উপস্থাপনের পাশাপাশি এবং বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ও বঞ্ছনার বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের স্বাক্ষরিত আদিবাসী অধিকার সনদে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত ছিল। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ আদিবাসী অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেনি। ফলে, রাষ্ট্রীয়ভাবে বা সরকারিভাবে বাংলাদেশে আদিবাসী দিবস পালিত হয় না। কিন্তু বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, উত্তরবঙ্গের বাংলাদেশ আদিবাসী পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন, আদিবাসীদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কিছু বেসরকারি সাহায্য সংস্থা বা এনজিও প্রভৃতি বাংলাদেশে আদিবাসী দিবস পালন করে।
আমি পত্রিকান্তরে লিখেছিলাম, ‘নানান আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে আদিবাসী দিবস পালনের অনুষ্ঠানমালায় থাকে আদিবাসী নৃত্য, বৈচিত্র্যময় র্যালি, আদিবাসী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও সেমিনার। এ দিনে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রদর্শনীর পাশাপাশি রাষ্ট্রের কাছে তাদের দুঃখ-দুর্দশা, আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা-বঞ্চনা, অত্যাচার নিপীড়ন এবং চাওয়া-চাহিদার বিষয়-আশয় উপস্থাপন করে। আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া, ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সমতলের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার সমাধানে গঠিত ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা, সিলেট- মৌলভীবাজার- হবিগঞ্জ- সুনামগঞ্জের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধান, মধুপুর-ভাওয়াল অঞ্চলের গারো আদিবাসীদের জীবনাচার বিনষ্ট করে ইকোপার্ক স্থাপন বন্ধ করে আদিবাসী সংস্কৃতিকে পণ্যে পরিণত করার প্রক্রিয়া বন্ধ করা, উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৮টি জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভিটামাটি রক্ষা ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা প্রভৃতি দাবি নিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও আদিবাসী সংগঠনগুলো বাংলাদেশে আদিবাসী দিবস পালন করে।’ প্রতিবছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে এসব কমন দাবি উচ্চারিত হয়, কিন্তু যাদের কানে যাওয়ার কথা তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। পরের দিনই সবাই আদিবাসীদের এ দাবি-দাওয়া এবং অধিকার আদায়ের আকুতি ভুলে যান। ফলে, সাত সাগর পাড়ি দিয়ে আদিবাসীরা সেই সৈকতেই পড়ে থাকেন।
এভাবেই প্রতিবছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস বাংলাদেশে পালিত হয়। কিন্তু আদিবাসীদের জীবনমানের কোনও উন্নতি হয় না। তাই, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২৪-এর ডাক অনুযায়ী ‘আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেদের অধিকতর শামিল করাটা’ এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। আদিবাসীদের অধিকারের কথা শুধু আদিবাসীরাই বলবে, এটা কেন হবে? আমাদের সবাইকে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলতে হবে। একটি আধুনিক ও উদার গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সব ধর্মের, বর্ণের, লিঙ্গের, জাতির এবং চিন্তার মানুষের সমমর্যাদার সহাবস্থান। তাই, আদিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারকেও যথাযথ মর্যাদায় স্বীকৃতি দিতে হবে। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, ৯.৮.২০২৪)
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়