যীশু সেন
আজকের সমাজে আদর্শ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে, যা দেশের জন্য একটি গভীর সংকট সৃষ্টি করছে। একদিকে আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ, অন্যদিকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করছে। আদর্শ মানুষের অভাবের কারণে সমাজে সঠিক নৈতিকতা, সহানুভূতি এবং দায়িত্বশীলতার অভাব দেখা দিচ্ছে। যা প্রতিটি স্তরের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে। এই পরিস্থিতি সমাজের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তুলছে।
বর্তমান সমাজে, মানুষের মধ্যে সততা, সাহস, ধৈর্য ও নৈতিকতার মতো আদর্শ গুণাবলী আজ বিলুপ্ত প্রায়। আজকাল সমাজে বেড়ে চলেছে অসৎ, হিংসা, স্বার্থপরতা, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান ও শিক্ষার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আদর্শের প্রতি উদাসীনতা ও অগ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত লাভের দিকে মনোযোগী, সমাজের কল্যাণ প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। এর ফলস্বরূপ, সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, যা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর।
রাজনৈতিক নেতা ও শাসকগণের দুর্নীতি, স্বার্থপরতা এবং অঙ্গীকারহীনতা সমাজের মধ্যে অসন্তোষ এবং অস্থিরতা তৈরি করছে। দুর্নীতি, অবিচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। এসব নেতিবাচক মনোভাব সমাজের মধ্যে সঠিক আদর্শ এবং মানবতাবোধের অভাবকে আরও তীব্র করে তুলছে। মানুষ এখন আর মানবিক গুণাবলী, সহানুভূতি এবং পরোপকারিতার কথা ভাবে না, কেবল বাহবা নিতে চায়।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অর্থ ও সামাজিক অবস্থান অর্জনের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। অধিকাংশ মানুষ এখন জীবনের মান উন্নত করতে মানবিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনে ছুটছে। ফলে দুর্নীতি, অন্যায়, অসত্য ও অবিচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পারিবারিক শিক্ষার অভাবও সমাজে সম্পর্কের দুর্বলতা তৈরি করছে।
এ সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, অনেক পরিবারে সন্তানদের শুধু শিক্ষিত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের নৈতিকতা, সামাজিক দায়িত্ব এবং মানবিক গুণাবলী গঠনের দিকে খুব কমই দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। একটি সুশিক্ষিত সমাজ শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। তাকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তবে অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানের নৈতিক শিক্ষার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেন না।
এই সংকট মোকাবিলার জন্য, আমাদের সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শ মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এটি সম্ভব হবে কেবলমাত্র যখন পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজের সকল স্তরের মানুষ সচেতন হবে। আদর্শ মানুষ গড়ে তুলতে পরিবারের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের শুধু শিক্ষিত নয়, সুশিক্ষিত ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন করে গড়ে তোলা। সন্তানদের মধ্যে নৈতিকতা, সহানুভূতি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি করতে পারলে, সমাজের অশান্তি কমে আসবে।
এ ছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন না করে, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল এবং মানবিক গুণাবলীর সঙ্গে পরিচিত হবে।
পরিশেষে, আদর্শ মানুষের সংকট এবং সমাজে অশান্তির প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে, আমাদের সকলকে একত্রিত হয়ে নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং সহানুভূতির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যদি সকলে একসঙ্গে কাজ করি, তবে সমাজে অশান্তি কমে আসবে এবং আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ সমাজ ও দেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো। এজন্য আমাদের উচিত আদর্শ মানুষ তৈরি করা। যারা শুধু নিজেদের জন্য নয়, গোটা সমাজ ও দেশের কল্যাণে কাজ করবে।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক