এমরান চৌধুরী
বর্তমানে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকে অর্থনৈতিক টানাপোড়ন। সে সাথে যদি বিশ্বাসে ঘাটতি থাকে তাহলে জ্বলে উঠে দাবানল। প্রাকৃতিক দাবানল আয়ত্তে আনা গেলেও মনের দাবানল নেভানো খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। ঘরে ঘরে এখন স্বামী- স্ত্রীর অমিল। ঘরে-বাইরে অশান্তির দাবানল। স্বামী চাকরীজীবী বা প্রবাসী, স্ত্রীকে সময় দিতে পারে না অথবা উভয়ে চাকরীজীবী অথবা স্বামী এবং স্ত্রী নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করেন। এমনকি বর্তমানে নারী স্বাধীনতার নামে আবার মেয়েরাও পরিবার ছেড়ে প্রবাসে চাকরির সুযোগ নিচ্ছে। ফলে পরস্পরের ব্যস্ততায় দাম্পত্য জীবন ব্যাহত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার যা একটি আদর্শ পরিবারের জন্য অশনি সংকেত।
প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে দুই চারটা খুনের ঘটনা। এই দুই চারটা খুনের ঘটনার মধ্যে কমপক্ষে একটি ঘটনা থাকে অনেকটা এরকম: স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন অথবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন কিংবা স্ত্রীর প্রেমিকের সহযোগিতায় স্বামী খুন। এক সময় যৌতুকের কারণে অনেক নারীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এখন যে হচ্ছে না তা নয়, তবে আগের তুলনায় কম। যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে কত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা নিজের শেষ সম্বলটুকু হারিয়েছেন তার সঠিক হিসেব নাই। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন সামাজিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে যে অবক্ষয় পরিবার ও সমাজের চিরায়ত সৌন্দর্য ধ্বংসে ভয়ংকররূপে প্রতিভাত হচ্ছে তার নাম পরকীয়া। অতীতে এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতো না তা নয়। তা ছিল কদাচিৎ। আজকের মতো নৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে তা কখনো চোখে পড়েনি।
বাংলা উইকিপিডিয়ার মতে পরকীয়া হলো বিবাহিত কোনো ব্যক্তির (নারী বা পুরুষ) স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে বিবাহোত্তর বা বিবাহ বহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকান্ড। এই অনৈতিক কর্মকান্ডে ধর্মবর্ণশ্রেণি নির্বিশেষে যে কোনো ব্যক্তি অবলীলায় জড়িয়ে পড়তে পারেন। তবে সবাই যে স্বেচ্ছায় এই কাজে প্রবৃত্ত হয় তা নয়। কোনো কোনো নারী দুশ্চরিত্র ব্যক্তির ফাঁদে পড়ে এই অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। পরে তা থেকে আর সহজে বেরিয়ে আসতে পারেন না। নানা ধরনের হুমকির মুখোমুখি হতে হয়। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নারীকে জিম্মি করে দিনের পর দিন পরকীয়ায় বাধ্য করার এমন নজিরও খুব একটা বিরল নয়। আবার দুই বিবাহিত নর ও নারীর পরস্পরের সম্মতিতে দেদারচে পরকীয়াও চলে সমানতালে। এই শ্রেণিতে উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত কেউ বাদ নেই। পরকীয়ায় আসক্ত লোকদের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সমাজের উঁচু শ্রেণি থেকে ঝুপড়িঘর কোনো বিভাজন নেই। সবখানেই বৈধ সম্পর্ক বিধ্বংসী এই খেলা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কেন এই অবৈধ লীলা? মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যৌন অতৃপ্তি থেকে এর সৃষ্টি। অতৃপ্ত রিপুর তাড়নায় তাড়িতে হয়ে কোনো কোনো ব্যক্তি এই অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। একজন পুরুষ যখন তার স্ত্রীর কাছে শারীরিক চাহিদা মেটাতে পারে না তখন সে বিপথগামী হয়। একইভাবে নারীদের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে থাকে। যৌন অতৃপ্তি কথাটা কোনো কোনো নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে সত্য তা অস্বীকার করার জো নেই। তাই বলে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে যৌন তৃপ্তি মেটানো কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ আজকাল নীতি ও নৈতিকতার তোড়াই কেয়ার করে। তারওপর প্রযুক্তি আমাদের যা কিছু কল্যাণ সাধন করেছে পাশাপাশি ভেঙে দিয়েছে নৈতিকতার দেয়াল। খোদাভীরুতার বদলে উসকে দিয়েছে অবৈধ মৌচাকে। কয়েক মিনিটের যৌনতৃপ্তি মুহূর্তেই একটি সাজানো সংসারকে, তিল তিল করে অর্জিত সুনামকে কীভাবে ধ্বংস করছে তা আমরা প্রায়ই জানতে পারছি পত্র-পত্রিকার সুবাদে। এ ধরনের কর্মকান্ড একটি পরিবারকে শুধু ধ্বংসই করে না, বিনি সুতোর বিশ্বাসে যে ফাটল ধরে শত চেষ্টায়ও তা আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। পরকীয়া সংসারে যে অশান্তির আগুনকে উসকে দেয় তার পরিণতি হয় খুবই ভয়াবহ। বর্তমান সমাজে দাম্পত্য কলহের বেশির ভাগ স্থান জুড়ে আছে পরকীয়া। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। এই পরকিয়ারও পরিণতি হয় ডিভোর্স বা খুনের মধ্য দিয়ে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রিয়.কম এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ৮০ শতাংশ নারী তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনে প্রধানতম অভিযোগ হিসেবে পরকীয়ার কথা উল্লেখ করেছে। অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে মাদকাসক্তি, প্রযুক্তি আসক্তি ইত্যাদি।
কোনো কোনো নারী পরকীয়ার কথা প্রকাশ হওয়ার পর লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহননের পথও বেচে নেয়।
আজকাল পারিবারিক কারণে যে সব হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়ে আসছে তার অন্যতম কারণ পরকীয়া। পরকীয়ার কারণে স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, কখনো ভাড়াটে খুনি বা পরকীয়ার সঙ্গীর হাতে নির্মমভাবে খুনের শিকার হচ্ছে স্বামী বা স্ত্রী। কখনো কখনো মা-বাবার পরকীয়ার কথা জানতে পেরে সন্তানরাও আপন স্বজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে দ্বিধা করছে না। এমন ঘটনাও দেখা যায়, শিশু সন্তান মায়ের পরকীয়া দেখে ফেলায় ঐ মাসুম শিশু বাচ্চার প্রাণ গেছে আপন মায়ের হাতে। অবৈধ এই কামলীলায় মত্ত লোকেরা এতটা উম্মাদ ও নৃশংস হয়ে উঠে যে পাগলা কুকুরের মতো যে কাউকে কামড় দিতে একটুও চিন্তা করে না। পরিবারের কোনো একজন (স্বামী অথবা স্ত্রী) যদি পরকীয়ায় আসক্ত হয় তা সংক্রামক ব্যাধির মতো পরিবারের অন্য সদস্যদের মাঝেও সংক্রমিত হতে পারে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ‘পিতামাতার পরকীয়া সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এবং সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সন্তানের মানসিক বিষণ্ণতা ও আগ্রাসী মনোভাবের জন্ম দেয়।’
পাশ্চাত্য আধুনিক সমাজেও পরকীয়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বিদ্যমান। সে সব দেশে অপরাধ প্রমাণিত হলে পরকীয়াকারী ব্যক্তির বিবাহিত সঙ্গী তার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আবেদন করতে পারে। ‘বাংলাদেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী পরকীয়া অনৈতিক হলেও ব্যভিচারের পরিণতি না পাওয়া পর্যন্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। তার মানে যৌনসঙ্গমহীন বিবাহ বহির্ভূত পরকীয়া আইনে অপরাধ নয় এবং এই পরকীয়ার অভিযোগে কাউকে দায়ী করা যায় না। অপরের বিবাহিত স্ত্রীর সাথে যৌনসঙ্গম সংঘটিত হলে তখন সেটি আইনের ভাষায় ব্যভিচার হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশের ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী ব্যভিচার আইনের চোখে অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য (সূত্রঃ ইন্টারনেট)। তবে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে ব্যভিচারের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান আর তাহলো পাথর নিক্ষেপ করে অপরাধীর মৃত্যুদন্ড। আল্লাহ পাক পরকীয়ার মতো জঘন্য কর্মকান্ড থেকে মুমিন বান্দাদের বিরত রাখতে সূরা নুর-এর ৩০-৩১ সংখ্যক আয়াতে বলেছেন, হে নবী! আপনি মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে এবং নিজের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে। এটিই তাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি। তারা যা কিছু করে আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন। আর হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলে দিন, তারাও যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে। আর তাদের সাজসজ্জা যেন প্রকাশ না করে যা নিজ থেকেই প্রকাশ হয়ে যায়। আর তারা যেন ওড়না দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে। নিজেদের যে সৌন্দর্য লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের সামনে প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না ফেলে। হে মুমিনরা! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তাওবা কর, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।
আইনে যা-ই থাকুক না কেন পরকীয়া নিঃসন্দেহে নীতি ও নৈতিকতার বিপক্ষে একটি বড় ধরনের অপরাধ। একজন বিবাহিত ব্যক্তি (নারী বা পুরুষ) অন্য ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে পারে না। কোনো সুস্থ ও বিবেকসম্পন্ন সমাজ তা মেনে নিতে পারে না। বিবাহ হচ্ছে একটি পবিত্র বন্ধন। আর পরিবারের মূলভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক বিশ্বাস। বিনি সুতোর মালায় গাঁথা এই বিশ্বাসে ছন্দপতন ঘটায় পরকীয়া। বিনষ্ট করে বিন্দু বিন্দু ঘামেগড়া একটি সাজানো বাগানোর শান্তি। আমরা যদি নিজেদের হেফাজত না করি, নিজের মান-সম্মান ও পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা মনে না রেখে কয়েক মিনিটের বিনোদনে নিজেকে সমর্পণ করি তাহলে পৃথিবীর কোনো আইন দিয়ে আমাদের অশুভ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারবে না। মনে রাখতে হবে একটিমাত্র ভুলের কারণে আমার আপনার সব কাছের মানুষ নাই হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয় সেই ভুলের মাসুল যুগ যুগ ধরে দিতে হতে পারে আপনার সন্তানদের। সুতরাং আসুন আমরা নীতি, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ নিজেদের মধ্যে লালন করি এবং পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধা, চাওয়া-পাওয়ার দিকে যত্নশীল হই। একমাত্র পারস্পরিক বিশ্বাসই হতে পারে একটি আদর্শ পরিবারের ভিত্তি।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক