এমরান চৌধুরী
‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়’। বেশিরভাগ সুইসাইড নোটে এই কথাটি লিখতে দেখা যায়। এই কথাটি কি আসলে আত্মহত্যাকারীদের মনের কথা! মনে হয় এক্ষেত্রে কোনো পাঠক হ্যাঁ সূচক জবাব দেবেন না। আমাদের ধারনা এরকম নোট লিখে যাবার পেছনে মূলত আত্মহত্যাকারীরা তাদের মৃত্যুর পর যাতে পরিবারের কেউ হেনস্তার স্বীকার না হয় সেই ব্যবস্হাটিই করে যায়। আরো গভীরভাবে ভেবে দেখলে দেখা যায় দুনিয়ে থেকে স্বেচ্ছায় চলে যেতে উদ্যত ব্যক্তিরা এতে করে নিজেকে উৎসর্গ করে হয়তো মহৎ হতে চায়। ইহলোকে একবিন্দু সুখ পায়নি। সহ্য করেছে নানা মানসিক পীড়ন। পরলোকেও কিছু পাবে না, এরপরও দুনিয়াতে রেখে যাওয়া প্রিয়জনদের সুখে রাখতে লিখে যায় আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়।
এই পৃথিবীতে মানুষ একবারই জন্মায়, দ্বিতীয়বার নয়। পুনর্জন্মে বিশ্বাসী কেউ কেউ থাকতে পারে। সেটা আলাদা কথা। এত সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে আসলে কোনো মানুষ যেতে চায় না। কিন্তু একদিন সব মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এই স্বাদ গ্রহণের আগে কিছু কিছু মানুষ আত্মহত্যা করে ভবলীলা সাঙ্গ করে। এটা কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। মানুষ কি এমনি এমনি আত্মহত্যা করে? নিশ্চিত না। যখন গরলে গরলে তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় তখন সে এই সুন্দর পৃথিবীর ছেড়ে পাড়ি দেয় পরলোকে। টা টা জানায় তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের। গরল হজম করা ছাড়াও কিছু সেনসেটিভ মানুষ থাকে যারা তুচ্ছ কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আবার অনেকে পরিবারের আত্মসম্মান রক্ষার্থে নিজেকে খুন করে বাঁচার প্রয়াসী হয়।
আত্মহত্যার বহুবিধ কারণ থাকে। কারণ ছাড়া কোনোকিছুই ঘটে না। তবে ঠুনকো কারণেও অনেক সম্ভাবনাময় মানুষ নিজেকে শেষ করে দেন। আমাদের দেশে অনেক কিশোর-কিশোরী আবেগের বশে পরস্পরের সান্নিধ্যে এসে পরে নানা বাধার মুখোমুখি হয়ে আত্মহনন করে।
প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে নানা দুঃসহ কারণ জড়িয়ে থাকে। নানা ঘটনা থেকে জানা যায়, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, নিঃসঙ্গতা, রোগযন্ত্রণা, হতাশা, অসমপ্রেম ও আর্থিক সংকট এসব কারণে বেশিরভাগ মানুষ আত্মহত্যা করে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত এক বছরে আত্মহত্যাকারী আদম সন্তানের সংখ্যা ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। বয়স অনুপাতে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ১৮ থেকে ২৫ বছরের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে।
নানা কারণে মানুষ সুইসাইড করলেও জীবন বিসর্জনের এ প্রক্রিয়ায় সমর্থন নেই কোনো ধর্মের। প্রায় সব ধর্মই আত্মহত্যাকে মহাপাপ ও ক্ষমার অযোগ্য বলে ঘোষণা করা করেছে। আর শান্তির ধর্ম ইসলামে বলা হয়েছে আত্মহত্যাকারী কখনো জান্নাতেই প্রবেশ করবে না। শুধু ইসলাম ধর্মই নয়, খ্রিস্ট ধর্ম বা সনাতন ধর্মেও আত্মহত্যাকে মহাপাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধর্মগুরুরা বলছেন, জীবন দান করেছেন সৃষ্টিকর্তা। আবার সেই জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকারও একমাত্র তার। মানুষের কোনো অধিকার নেই আত্মহননের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর আত্মহত্যা করে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা হলো ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ।
সমানজিজ্ঞানীদের মতে, কোনো কারণে পড়াশুনায় খারাপ করা, চাকরি চলে যাওয়া, মানসিক চাপ, প্রেমে বিফলতা নানা কারণেই অনেক মানুষ আত্মহত্যা করছে। বিশেষ করে মহামারি করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে এটা আরো বেড়ে গেছে।
শুরু করেছিলাম সুইসাইড নোট নিয়ে। স¤প্রতি চট্টগ্রামে একজন সহকারী পুলিশ কর্মকর্তা (এএসপি) সুইসাইড নোট লিখে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। গত ৭মে ২০২৫ বুধবার দুপুর ১২টার দিকে তিনি আত্মহত্যা করেন। এ পুলিশ কর্মকর্তার নাম পলাশ সাহা। জানা যায় তিনি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার তারাশি গ্রামের বিনয় সাহা ও আরতি সাহার সন্তান। লাশের পাশের পাওয়া সুইসাইড নোটে তিনি তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয় বলে লিখে যান। চিরকুটে যা লেখা ছিল : ‘আমার মৃত্যুর জন্য মা এবং বউ কেউ দায়ী না। আমিই দায়ী। কাউকে ভালো রাখতে পারলাম না। বউ যেন সব স্বর্ণ নিয়ে যায় এবং ভালো থাকে। মায়ের দায়িত্ব দুই ভাইয়ের ওপর। তারা যেন মাকে ভালো রাখে। স্বর্ণ বাদে যা আছে তা মায়ের জন্য। দিদি যেন কো-অর্ডিনেট করে।
সুইসাইড নোট পড়ে সাধারণ পাঠক যা-ই ধারনা করুন প্রতিটি আত্মহত্যা দুঃখজনক এবং তার পেছনে কোনো কোনো কারণ ক্রিয়াশীল। তবে কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না এই সেই কারণ। গত ৮ মে যুগান্তর অনলাইনে কোটালীপাড়া (গোপালগঞ্জ) প্রতিনিধির বরাত দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘পলাশের মেজো ভাই নন্দ লাল সাহা বলেন, প্রতিদিন কিছু না কিছু নিয়ে পলাশের স্ত্রী সুস্মিতা সাহা পরিবারে ঝামেলা করত। আমার মা আরতি সাহা পলাশের সঙ্গে চট্টগ্রামে থাকতেন-এটা পলাশের স্ত্রী মেনে নিতে পারত না। সে সব সময় মাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য পলাশকে চাপ দিত। পলাশ কিছুতেই মাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চাইত না। সে মা ও তার স্ত্রী দুজনকেই ভালোবাসত। বুধবার সকালে সামান্য বিষয় নিয়ে আমার মা আরতি সাহা ও ভাই পলাশের গায়ে হাত তোলে সুস্মিতা। এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি আমার ভাই। আর এ কারণেই পলাশ আত্মহত্যা করেছে বলে আমাদের ধারণা।’
একজন মানুষ আত্মহত্যা করলে এবং চিরকুট লিখে কেউ দায়ি নয় বলে গেলেই কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। বরং সমস্যা আরও বাড়তে পারে। আত্মহত্যা করে আত্মহত্যাকারী পার পেয়ে গেলো বটে কিন্তু যারা বেঁচে আছেন তাদের প্রতি সমাজের তীক্ষ ফলা প্রতিদিনই বিদ্ধ হতে থাকবে। নানা মুনির নানা মতের কারণে অনেক অপ্রিয় কথা বেরিয়ে আসবে। তাই কোনো পরিবারে যে কোনো কারণে মনোমালিন্য বা গৃহবিবাদ থাকলে সংসারের প্রতিটি পক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। ঝগড়া-বিবাদ করে কেউ বেরিয়ে তথা কর্মক্ষেত্র বা বাপের বাড়ি বা অন্যত্র চলে গেলে তার খোঁজ-খবর নিতে হবে। বলা তো যায় না কোথায়, কখন, কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে। পরিবারে যদি কেউ বিষণœতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া, মাদকাসক্তি ইত্যাদি মানসিক রোগী থাকেন তাদের যথাযথ চিকিৎসা করাতে হবে এবং সম্পর্কজনিত জটিলতা থাকলে যে কোনো পক্ষকে হার মেনে হলেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে সব হারিয়ে বোঝার আগে কিছু হারিয়ে নিজেকে যদি সতর্ক, সংযত রাখতে পারেন তবেই জীবনটা সুন্দর হয়ে উঠবে। হারিয়ে বুক চাপড়ানোর আগে হারানোর আগে নিজের হাত ও মুখকে শৃঙ্খাবদ্ধ করুন। কারণ পৃথিবীতে মুখের চেয়ে মানববিধ্বংসী কোনো মারণাস্ত্র অদ্যাবধি আবিস্কার হয়নি। তাই নিজ নিজ মুখ সংযত রাখুন। পৃথিবীর কোনো দেশে মুখকে সংযত রাখার জন্য কোনো ডলার/ পাউন্ড/ দিনার/ রুপি/ টাকা খরচ করতে হয় না।আর হাতকে নিম্মমুখি রাখুন। সম্মানিত ব্যক্তির উপর এটার ব্যবহার আপনার বংশকেই কলংকিত করবে। সংসার তো সমারাঙ্গনই। এই সমরাঙ্গনে টিকতে হলে কাউকে না কাউকে ছাড় দিতে হবে। এই ছাড় দিতে গিয়ে যদি আপনার কোনো ক্ষতিই হয় মনে রাখতে হবে এটা সংসারের শান্তির জন্য বড় বিনিয়োগ।সবচে বড় কথা মনোবিজ্ঞানীদের মতে,পরিবারে যদি কেউ আত্মহত্যা করে, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও মাঝেও এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই নিজে বাঁচুন। অন্যকেও এই সুন্দর পৃথিবীর দেখতে সাহায্য করুন।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক