আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইসরায়েলের টানা বিমান হামলায় যখন তেহরানের আকাশে বোমার শব্দ থামছে না, তখন কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ পোষা প্রাণী, পারিবারিক দায়বদ্ধতা কিংবা নিছক অচলাবস্থার কারণে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন রাজধানীতেই। তেহরান যেন এখন অপেক্ষার শহর। প্রতিরোধের সংকল্প, পালানোর চেষ্টায় ব্যর্থতা, আর অনিশ্চয়তার ঘন ছায়ার মাঝে ক্লান্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
৩৭ বছর বয়সী কম্পিউটার বিজ্ঞানী মিনা বললেন, তেহরানের পশ্চিমাংশে আমার বাড়ির কাছেই একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছি। আমি তেহরান ছেড়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কয়েকটি বিড়াল আছে, আমি তাদের ফেলে যেতে পারি না।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের পরিসংখ্যান অনুসারে, শুক্রবার শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২২৪ জন ইরানি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। রাজধানীর বহু এলাকা ইতোমধ্যে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। পাল্টা জবাবে ইরানের হামলায় ইসরায়েলে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়।
সোমবার ইসরায়েল তেহরানের উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের সরে যেতে সতর্ক করে দেয়। এরপরই তারা রাষ্ট্রায়ত্ত স¤প্রচার সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালায়। এতে তিনজন নিহত হন বলে জানিয়েছে ইরানি টেলিভিশন।
এর দুই দিন আগে ইসরায়েল ঘোষণা দেয়, তারা ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে তেহরানে যাওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। এই ঘোষণার পর রাজধানীর রাস্তায় ভয়, অচলাবস্থা এবং প্রতিবাদের মিশ্র চিত্র ফুটে উঠেছে।
মঙ্গলবার সকালে তেহরানের রাস্তায় রুটির দোকান, পেট্রোল পাম্পে লম্বা লাইন দেখা গেছে। কোথাও কোথাও কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ ছিল তা। অল্প কিছু মুদি দোকান ও ফার্মেসি খোলা থাকলেও জুয়েলারি ও খুচরো দোকানগুলো ছিল বন্ধ।
নগরীর বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছে। পুলিশের উপস্থিতি ও তল্লাশি আরও বাড়ানো হয়েছে। অনেকেই পানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় সাময়িকভাবে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আতঙ্ক ও দ্বিধায় তেহরানে দিন কাটছে সাধারণ মানুষের তেহরানের প্রধান সড়কগুলোতে যান চলাচল কম। কিছু এলাকায় ওষুধের দোকানের বাইরে লাইন দেখা গেলেও শহরের বড় অংশ নিস্তব্ধ। সামাজিক যোগাযোমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু যাচাই করা না ভিডিওতে বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, জানালার কাচ ভেঙে পড়া এবং ঘরে ধ্বংসস্তূপের চিত্র দেখা গেছে।
তাজরিশ স্কয়ারে পানির একটি লাইন মেরামতের কাজ চলছে। একদিকে জনগণের দুর্ভোগ, অন্যদিকে শহরের দেয়ালে ঝুলছে রাষ্ট্রীয় স্লোগান আর প্রতিরোধের বার্তা।
তেহরানের শহরতলীতে একটি ব্যানারে লেখা: ‘কঠিন শাস্তির জন্য প্রস্তুত থাকো জায়নবাদী শাসক।’ পাশে শহীদ সামরিক কর্মকর্তাদের ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের ছবি। অন্য এক ব্যানারে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির উক্তি: ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর শক্ত হাত জায়নবাদীদের রেহাই দেবে না।
ভালি-আসর স্কয়ারে দেখা গেছে সাহার ইমামির ছবি। ইসরায়েলি হামলার সময় রাষ্ট্রীয় স¤প্রচার কেন্দ্রের স¤প্রচার চালিয়ে যাওয়া এই উপস্থাপককে সম্মান জানানো হয়েছে। তার তর্জনী উঁচিয়ে রাখা ছবির পাশে স্থান পেয়েছে ইরানি কবি ফেরদৌসির এক পঙ্ক্তি: ‘নারী যদি চায়, সে যুদ্ধক্ষেত্রেও সাহস দেখাতে পারে।’
আতঙ্ক ও দ্বিধায় তেহরানে দিন কাটছে সাধারণ মানুষের
উৎকণ্ঠা, অসহায়ত্ব আর জিজ্ঞাসা: ‘চলে যাবো, কিন্তু কোথায়?’ ইসরায়েল যখন তেহরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চল খালি করতে বলে, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সতর্কবার্তা, ‘সবাই যেন তেহরান ত্যাগ করে’।
এই নিয়ে বিবিসি পার্সিয়ানকে এক বাসিন্দা বলেন, তারা বলে শহর খালি করো! কিন্তু কীভাবে? যাবে কোথায়? কিসে যাবে? এমন অমূলক কথা বলেন কীভাবে?
আরেকজন জানান, তিন দিন ধরে তিনি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। তার কথায়, প্রতিবার কোনও হামলার খবর শুনলেই মনে হয়—বেঁচে আছেন তো? আমার বাবার কাছে ইন্টারনেট নেই, মা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।
ইউরোপে থাকা এক ইরানি মেডিক্যাল শিক্ষার্থী বলেন, আমরা যারা দেশের বাইরে, আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা পরিবারকে নিয়ে উদ্বেগ। ইরানের আকাশসীমা যদি বন্ধ না থাকত, আমরা অনেকেই ফিরে যেতাম।