নিজস্ব প্রতিবেদক
আট বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি থাকা বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব লায়ন আসলাম চৌধুরী আজ মুক্তি পাচ্ছেন। সর্বশেষ রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় হাইকোর্টের দেয়া জামিন গতকাল সোমবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ বহাল রেখেছেন। এর ফলে তার মুক্তিতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বিএনপি নেতা লায়ন আসলাম চৌধুরী আট বছর চারমাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি। তার বিরুদ্ধে ৭৬টি নাশকতা, বিস্ফোরক, বিশেষ ক্ষমতা, দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও চেকের মামলা রয়েছে। তিনি ৭৬টি মামলাতেই জামিন পেয়েছেন। তবে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া জামিন চেম্বার জজ স্থগিত করার কারণে মুক্তি পাচ্ছিলেন না। গতকাল সোমবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চে স্থগিতাদেশের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে আসলাম চৌধুরীর জামিন বহাল রাখা হয়।ফলে আজ আসলাম চৌধুরী মুক্তি পেতে পারেন।
আসলাম চৌধুরীর এপিএস মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘সব মামলায় স্যার জামিনে আছেন। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জামিন স্থগিত ছিল, সেটাতেও জামিন হয়েছে। আইনজীবীরা সমস্ত কাগজপত্র কারাগারে পাঠিয়েন। মঙ্গলবার স্যার কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করবেন।’
২০১৬ সালের ১৫ মে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা লায়ন আসলাম চৌধুরী। তারপর তার বিরুদ্ধে নতুন নতুন নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলা হতে থাকে। মোসাদ কানেকশনের অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও হয়। তিনি ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার হলেও, তাকে ২০১৩ সালে হেফাজত আন্দোলনের সময় দায়ের হওয়া নাশকতার মামলায়ও শ্যোন অ্যারেস্ট দেখায় আওয়ামী লীগ সরকার। তাকে বিনা বিচারে আট বছর চার মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ৭৬টি মামলার মধ্যে কোনো মামলাতেই এখনও তার সাজা হয়নি, কোনো মামলায় তিনি খালাসও পাননি। চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকায় তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্ঠা লায়ন আসলাম চৌধুরীর রাজনীতিতে উত্থান খুব দ্রæতই। বিএনপি নেত্রীর কাছেও দ্রæত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেন তিনি। দলীয় কোন্দলের উর্ধ্বে উঠে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেন নিজেকে। যার কারণে আসলাম চৌধুরী চট্টগ্রামের রাজনীতিতে হঠাৎ অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখে আবদুল্লাহ আল নোমান, এম মোরশেদ খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন সহ চট্টগ্রামের অন্য সিনিয়র বিএনপি নেতাদের চেয়ে দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন আসলাম চৌধুরী। এমনকি তাকে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতাও দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের বিএনপির সিনিয়র নেতারা তার এ উত্থানে কিছুটা হতভম্ব হলেও কারো সাথে বিরোধে জড়াননি আসলাম চৌধুরী। ফলে উত্তর জেলাজুড়ে রয়েছে এ নেতার বিশাল ভক্ত।
সূত্র বলছে, ২০০২ সালে জিয়া পরিষদের মাধ্যমে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন আসলাম চৌধুরী। তখন বিএনপির এই অঙ্গসংগঠনের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। পরে ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। এরপর দুই বছরের মধ্যে উঠে আসেন জেলার সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে। পাশাপাশি জায়গা করে নেন কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে। ৫ বছর পর ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল জেলা বিএনপির সভাপতির পদও তার দখলে চলে আসে। তার দুই বছর পর কিছুদিন আগে দলের যুগ্ম মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে চলে আসেন তিনি। আসলাম চৌধুরীর এমন উত্থানে চট্টগ্রামের অনেক বিএনপি নেতাও হতবাক। তারেক রহমানের আস্থাভাজন হিসেবে ক্রমেই পরিচিত হতে থাকেন এই বিএনপি নেতা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন আসলাম চৌধুরী। ১৯৯৬ সালে কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে এফসিএ পাস করেন। চাকরি নেন চট্টগ্রামের কবির স্টিল মিল নামের একটি রড কোম্পানিতে। পরে এখান থেকে কনফিডেন্স সিমেন্ট কোম্পানির অর্থ ব্যবস্থাপক পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে এই সিমেন্ট কোম্পানিতে সিএফও (হিসাব বিভাগের প্রধান) পদে কর্মরত ছিলেন। চাকরিতে থাকাকালীন তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরে চাকরি ছেড়ে কনফিডেন্স সল্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে শুরু করেন ব্যবসা। যোগ দেন বিএনপির রাজনীতিতে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বেশ কয়েকটি রুগ্ন শিল্পকারখানা কেনেন আসলাম চৌধুরী। এর মধ্য দিয়ে রাইজিং গ্রুপ নামে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। এ গ্রুপের আওতায় ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো হয়। তার গড়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বোয়ালখালীতে কনফিডেন্স লবণ কারখানা, সীতাকুন্ডসহ বেশ কয়টি স্থানে সিএনজি ফিলিং স্টেশন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দখল করে স্বয়ংক্রিয় ইটভাটা, চকরিয়ার হারবাংয়ে অবস্থিত ইনানি রিসোর্ট, চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ ও সাগরিকা সড়কে ফিশ প্রিজার্ভার্স নামে দুটি মৎস্য সংরক্ষণ কারখানা। এ ছাড়া সীতাকুন্ডে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা, এয়ার এভিয়েশন, আবাসনসহ হরেক রকমের ব্যবসা রয়েছে তার।
এদিকে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীকে কারাগার ফটকে বরণ করে নিতে প্রস্তুতি নিয়েছেন নেতারা। আজ সন্ধ্যায় কারা ফটকে উপস্থিত থাকবেন দলের নেতারা। ফুল দিয়ে বরণ করার পর হবে আনন্দ মিছিল। তাছাড়া সীতাকুন্ডেও আনন্দ মিছিল হবে বলে জানিয়েন একাধিক নেতা।