আবু তালেব বেলাল
আজ ১২ রবিউল আওয়াল, সোমবার পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন হচ্ছে। মানবতার মুক্তির কান্ডারী, সৃষ্টিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, নবীকুল সরদার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পৃথিবীতে শুভাগমনের এ দিনটি অত্যন্ত মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলমানদের কাছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) হিসেবে পালিত হয়।
উল্লেখ্য, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এ দিনে সৌদি আরবের মক্কা নগরে বিখ্যাত কোরাইশ বংশে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের একই দিনে তিনি ওফাতপ্রাপ্ত হন। নবীজির (সা.) বাবা আবদুল্লাহ ও মা আমিনা। জন্মের আগেই রাসুল (সা.) বাবাকে হারান এবং ছয় বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন।
আরব জাহান যখন পৌত্তলিকতা ও অনাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, সেই আইয়ামে জাহেলিয়ার সময় মহান আল্লাহ সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও একত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রিয় হাবিবকে অপার রহমত হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। এ কারণে রাসুলকে (সা.) সম্মান জানিয়ে রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবেও সম্বোধন করেছেন মহান আল্লাহ।
বিনয়, সহিষ্ণুতা, দয়া, সহমর্মিতাসহ সব মানবিক সদগুণের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণাবলির অধিকারী হিসেবে তিনি ধর্ম-বর্ণ-স¤প্রদায় নির্বিশেষে সর্বকালে সর্বজনস্বীকৃত। ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যবাদিতার জন্য শৈশবেই তিনি ‘আল আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হন। সব নবী ও রাসুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহানবী (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত পান। এরপর ২৩ বছর তিনি তৌহিদের বাণী প্রচার করেছেন। আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনে এবং সমাজে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আজ কোরআন তিলাওয়াত, খতমে বুখারী, দরুদ পাঠ, মিলাদ মাহফিল, ওয়াজ-নছিহত, নফল এবাদতসহ নবীজির (সা.) জীবনী নিয়েও আলোচনা করবেন। এছাড়া গরীব-মিসকিনদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও জশনে জুলুসসহ বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগির মধ্যদিয়ে দিনটি পালন করবেন।
আজ দেশব্যাপী বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইসলামি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা এবং বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ করে সরকারিভাবে আজকের দিনটি জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হবে।
এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।
সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়িত্বশাসিত ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে আজ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে, সেই সাথে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ও আদর্শের উপর আলোচনা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন উপলক্ষে দেশের সবচেয়ে বড় জশনে জুলুস (ধর্মীয় শোভাযাত্রা) অনুষ্ঠিত হয় বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি এ চট্টগ্রামে। আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় জুলুসটি বের করা হবে। আওলাদে রাসুল, রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ (ম.জি.আ) এতে নেতৃত্ব দিবেন। শাহজাদা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ কাসেম শাহ সাথে থাকবেন।
আজ সোমবার সকাল ৯টায় নগরীর ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন আলমগীর খানকাহ থেকে জশনে জুলুস বের হয়ে বিবিরহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর, ২নং গেট, জিইসি মোড় হয়ে অবারও একই পথে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন জুলুস ময়দানে গিয়ে শেষ হবে। এ সময় আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ’র (ম.জি.আ.) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হবে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল। মাহফিলে প্রধান অতিথি থাকবেন শাহজাদা আল্লামা সৈয়দ কাসেম শাহ (ম.জি.আ.)। মাহফিলে দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরাম, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সংগঠন ও পেশার শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন। বাদে জোহর আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম, দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করে জশনে জুলুসের সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।
সাজ সাজ রব নগরজুড়ে : আকাশে রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে সাজ সাজ রব উঠেছে চট্টগ্রাম নগরজুড়ে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রঙের বাতির ঝলকে নগরীর রাজপথ, উড়াল সড়ক, অলিগলি সবখানে ঝলমল করছে। সাথে উড়ছে চাঁদ-তারকা খচিত বিভিন্ন রঙের পতাকা। মোড়ে মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সুসজ্জিত-সুদৃশ্য তোরণ। যেখানে লেখা রয়েছে ‘আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ’। ‘আহলান সাহলান ইয়া মাহে রবিউল আউয়াল’। এর সাথে নগরীর প্রতিটি মোড়ে আনজুমান লোগো খচিত চতর্ভুজ ডিজাইনের ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে। যেখানে কোরআন-হাদিসের বাণী, জশনে জুলুসের প্রবর্তক গাউস জামান আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (র.) এর বাণী লেখা রয়েছে। এ রঙ, এ সাজ দেখে বারবার হৃদয়ে এসে ধরা দিচ্ছে সেই অমর সঙ্গীত, ‘ত্রিভ‚বনে প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়/ আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়…’।
আর ঈদে মলাদুন্নবী (সা.) এর জশনে জুলুসই যেন সেই মরু দুলালীকে মদিনাবাসীর বরণের বর্ণাঢ্য আয়োজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে রবিউল আউয়াল এলেই তৈরি হয় উৎসবের আমেজ। ঐতিহাসিক জশনে জুলুসকে ঘিরে সর্বস্তরের মুসলমানদের মাঝে নেমে আসে ঈদের আনন্দ।
১২ রবিউল আউয়াল জুলুস উপলক্ষে নেওয়া হয় সর্বাত্মক প্রস্তুতি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নগরীর কর্ণফুলী শাহ আমানত ব্রিজ থেকে শুরু করে বহদ্দারহাট, আবার একই স্থান থেকে চাকতাই কোতয়ালি, নিউ মার্কেট, লালদীঘি, জামাল খান, বিমানবন্দর সড়ক হয়ে ইপিজেড, বারিক বিল্ডিং, আগ্রাবাদ, দেওয়ানহাট, টাইগারপাস, ইস্পাহানি, ওয়াসা হয়ে ২নং গেট, মুরাদপুর হয়ে বিবিরহাট, অক্সিজেন সর্বত্রই লেগেছে আলোর ছোঁয়া, উঠেছে সাজ সাজ রব। এর পাশাপাশি জামেয়া সংলগ্ন জুলুস মাঠে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল ও মঞ্চ।
আনজুমান-এ রাহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট এবং তাদের সহযোগী সংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ প্রায় দুইমাস ধরে এ জুলুসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জুলুস প্রস্তুতি কমিটির আহব্বায়ক আনজুমানের অ্যডিশনাল সেক্রেটারি জেনারেল আলহাজ সামশুদ্দিন এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, জশনে জুলুস উপলক্ষে একটি কেন্দ্রীয় প্রস্তুতি কমিটি এবং এর অধিনে ১৪টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রত্যেক সদস্য নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে জশনে জুলুসের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।
আন্জুমান, গাউসিয়া কমিটির পাশাপাশি আনজুমানের নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স (এএসএফ), সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, র্যাবসহ সরকারের সকল গোয়েন্দা সংস্থা জুলুসের সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
জুলুস প্রস্তুতি কমিটির আহব্বায়ক ও আনজুমান ট্রাস্টের এডিশনাল সেক্রেটারি সমশুদ্দিন জুলুসে আগত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আনজুমান ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া নির্দেশনা মেনে সুশৃঙ্খলভাবে জুলুসে উপস্থিত হওয়ার আহবান জানান।
এ বিষয়ে গাউসিয়া কমিটির চেয়ারম্যান পেয়ার মোহাম্মদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও গাউসিয়া কমিটির পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবক জুলুসের শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবেন। নগরীর প্রতিটি মোড়সহ জামেয়ার আশেপাশে জুলুসে আগত মুসল্লিদের যাতে কোন রকম কষ্ট না হয়, সেদিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখা হবে।
অপরদিকে গত শনিবার সকালে দামপাড়া পুলিশ লাইনের সিএমপির সম্মেলন কক্ষে আনজুমান ট্রাস্ট নেতৃবৃন্দের সাথে সর্বশেষ প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করেন সিএমপি কমিশনার।
বৈঠকে পুলিশ কমিশনার বলেন, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে সোমবার নগরীতে জশনে জুলুস (ধর্মীয় শোভাযাত্রা) ঘিরে পুলিশ বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। শোভাযাত্রায় যেন কেউ ব্যাগ বা পোটলা নিয়ে অংশ নিতে না পারে এবং দুষ্কৃতকারীরা যাতে মুসল্লির ছদ্মবেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা জনিত যেকোন জরুরি সেবা পেতে ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করার আহŸান জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত সদস্যদের পাশাপাশি পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়নে সার্বিক দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন সিএমপি কমিশনার।
গতকাল পাঁচলাইশ থানা কর্তৃপক্ষের সাথেও আনজুমানের জুলুস প্রস্তুতি কমিটির বৈঠক হয়। তাতে জুলুসের সার্বিক নিরাপত্তাসহ সকল বিষয়ে আলোচনা হয় বলে আনজুমান সূত্রে জানা গেছে।
পবিত্রতা ও খুশীমনে জুলুসে শরিক হোন : আনজুমান ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মহসিন ও সেক্রেটারি জেনারেল আনোয়ার হোসেন বলেন, ঈদ মানে আনন্দ। যার ওসিলায় আমরা আল্লাহর সৃষ্টি জগৎ পেয়েছি, ইসলাম ও শরীয়ত পেয়েছি, দুই প্রধান ঈদ পেয়েছি, সেই মানবতার নবী (সা.) যেদিন এ দুনিয়াতে এসেছেন, সেই দিনই হচ্ছে সেরা ঈদ। আমাদের হুজুর কেবলা তৈয়ব শাহ (র.) এর অছিলায় জুলুস পেয়েছি। ১২ রবিউল আউয়াল সকালে পবিত্রতার সাথে খুশী ও আনন্দ চিত্তে জুলুসে অংশগ্রহণ করবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান- এটাই কামনা করি। তারা চট্টগ্রামবাসীসহ সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে ঈদে মিলাদুন্নবীর শুভেচ্ছা জানান এবং জশনে জুলুসকে সফল করার আহবান জানান।