আগুন ঝরা ফাগুন

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

অমর একুশের ভাষাশহীদদের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি আমাদের এমন এক আবেগের কেন্দ্রে অবস্থান নেয়, যা কেবল একটি মাস মাত্র নয়, একটি চেতনা। সারা পৃথিবীতেই ফেব্রুয়ারি আসে, তবে বাংলাদেশে যেভাবে ফেব্রুয়ারি আসে; তেমন করে আর কোথাও নয়। ফেব্রুয়ারির গোটা মাসটাই আমাদের গৌরবের আর আত্মমর্যাদাপূর্ণ ত্যাগের স্মৃতিতে ভাস্বর।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আত্মদানের অবিস্মরণীয় ইতিহাস গড়েছি আমরা। সালাম, বরকত, রফিক, শফিউরের মতো অগণিত স্বজন হারানো শোকের একুশে কালক্রমে শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আমরা অবশেষে এই প্রত্যয় স্থিত হয়েছি যে, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। একুশের তাৎপর্য নিয়ে লেখা হয়েছে প্রচুর, আরও লেখা হবে অনাগত কাল ধরে। কারণ ফেব্রুয়ারি আর একুশে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এমনই সুদূর প্রভাব বিস্তারী যে, এর বহুমাত্রিকতা বাতাসের মতো বেঁচে থাকার অনিবার্য উপকরণ, এমনকি প্রাণশক্তিও। সে কারণেই বায়ান্নের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ আমাদের পৌঁছে দিতে পেরেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের একাত্তরে।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি আমাদের স্বাধিকার চেতনা তথা স্বাধীনতার বীজ বোনার মাস, বীজ বোনা হয়েছিল রক্তস্নাত চেতনার ভ‚মিতে, সেই ফেব্রুয়ারি এলেই একুশের মহান ভাষাশহীদদের এবং বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত সব শহীদের স্মৃতি আমাদের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়। সচেতন নাগরিক মাত্রই নতুন করে শক্তি উপলব্ধি করেন। কিন্তু একুশের চেতনা বা স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার বোধ শুধু সচেতন নাগরিকদের মধ্যে জেগে থাকলেই হবে না, সার্বিক জাতীয় জাগরণের জন্য তা আমজনতার মধ্যেই ছড়িয়ে দিতে হবে। যত দিন তা আমরা পারব না, তত দিন আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্তরায় দূর হবে না।
ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন দুটি রাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তানের জন্মের এক বছরের মধ্যেই ঘটেছিল একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮। করাচিতে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের অধিবেশন বসেছে। তাতে গণপরিষদের কার্যক্রম ঊর্দু এবং ইংরেজিতে হবে তা পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু এমন অযৌক্তিক নির্ধারণ কেন মেনে নেবে বাংলার মানুষ? কুমিল্লার কৃতী সন্তান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি যৌক্তিক প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন- ঊর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাও পার্লামেন্টের কার্যক্রমে ব্যবহার করা হোক। কারণ তিনি তথ্য দিয়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে ৪ কোটিরও বেশি লোকের ভাষা বাংলা, অর্থাৎ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই বাংলা। তাই বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে দেখা উচিত নয়। বাংলাও হওয়া উচিত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’।
কিন্তু তার এই যৌক্তিক সংশোধনী প্রস্তাব সেদিন পার্লামেন্টে টেকেনি পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকদের বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখার কারণে। এমন কি সেদিন গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরাও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের পক্ষে কোনো কথা বলতে পারেননি সংসদীয় দলের আপত্তির কারণে।