আগুন ঝরা ফাগুন

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

একুশের চেতনার জন্ম হয়েছিল এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার একপর্যায়ে উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব ও ভাগ্যকে জুড়ে দেয়া হয়েছিল কৃত্রিম ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে। তদানীন্তন পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা সাত জনের মুখের ভাষা ঊর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। উনিশ শ’ আটচল্লিশ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করা হয়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধূমায়িত হতে থাকে পুঞ্জীভ‚ত বিক্ষোভ। উনিশ শ’ ঊনপঞ্চাশ থেকে উনিশ শ’ একান্নের মধ্যে ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি। তা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল ইস্যু হয়ে ওঠে।
উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের সেই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তায় জন্ম নিয়েছিল একুশের চেতনা। এই চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সেদিন পূর্ব বাংলার অধিকার-বঞ্চিত মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণআন্দোলনের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ওই আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সে সময়ে বাঙালির আত্মসচেতনতা ও আত্মপরিচয়ের যে উদ্বোধন ঘটেছিল তা-ই নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রূপ নিয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। এরপর একুশের পথ ধরেই আমরা বারবার পেরিয়ে এসেছি সংকটের নানা আবর্ত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভাববীজ আমরা পেয়েছি মহান ভাষা আন্দোলন থেকে।
একুশের চেতনার তাৎপর্য বহুমুখী। প্রথমত, বাঙালির জাতীয় চেতনাকে একুশ দিয়েছে স্ফটিকস্বচ্ছতা। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির ওপর যে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনায় সংগঠিত হতে একুশ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের সচেতন, সক্রিয় ও প্রাণিত করেছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায়। একুশের চেতনা ক্রমেই পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়। দ্বিতীয়ত, বাঙালির জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কারে একুশের অবদান অসামান্য। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সংকীর্ণ ধর্মাচ্ছন্নতাকে ছাপিয়ে উঠেছিল জাতিগত চেতনা। সেই চেতনা আমাদের এই মর্মে সচেতন করেছে যে, আমরা বাঙালি। আমরা জেনেছি, বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার, বাংলাদেশ আমাদের দেশ। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরে আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের ঠিকানা ও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করেছি। একুশের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা। তৃতীয়ত, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রæয়ারি যেন হাজার তারের বীণা। তাতে কত না সুর, কত না ঝংকার।