নিজস্ব প্রতিবেদক
শহীদের রক্তে ভাস্বর একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের অনুপ্রেরণারই উৎস নয়, এর একটি দিকনির্দেশনাও রয়েছে। এর মূল কথা- জীবনের সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার চর্চা। উনিশ শ’ পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা ছিল প্রবল। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এর ব্যবহারিক কার্যকারিতা কার্যত স্থগিত করে রাখা হয়েছিল। এই চতুরতা কি তখন বাঙালি বুঝতে পেরেছিল?
মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রশ্নে সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রটি ছিল শিক্ষার। সে সময় এ ক্ষেত্রে একটা বাস্তব সুবিধা ছিল। পূর্ব বাংলার সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা বাংলা। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে হাতে গোনা কয়েকটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাকলেও মোট বিদ্যালয়ের অনুপাতে তা ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না। অলিগলিতে অপরিসর অস্বাস্থ্যকর ভবনে তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি ভার্সন স্কুল তখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে স্কুল পর্যায়ে মাতৃভাষাতেই পাঠদান হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আর ওসব স্কুলের ছাত্রদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা আজকের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের চেয়ে কম ছিল বলে মনে হয় না।
স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলার শুরুতে মনে হয়েছিল যে শিক্ষার সবকিছু বাংলায় হবে। কিন্তু ওই দশক শেষ হতে না হতেই দৃশ্যপটের বদল শুরু হলো। এর পটভ‚মিতে একদিকে ছিল শাসনক্ষমতায় রক্তাক্ত পরিবর্তন, অন্যদিকে ইংরেজিসহ বিশ্বের অন্যান্য ভাষার দেশে শিক্ষা ও চাকরির জন্য যাওয়া। দেশে প্রথমে কিছু ভালো মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলো এবং এরই সুবাদে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন এলিট গড়ে উঠল। তার চেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটল যখন সারা দেশে, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন গজিয়ে উঠল এবং নিম্নমধ্যবিত্তরাও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুঝতে পারল না যে তাদের সংগতির মধ্যে থাকা স্কুলগুলোতে ভালো কাঠামো ভাড়া করা বা ভালো শিক্ষক রাখা সম্ভব নয়, সুতরাং ভালো শিক্ষা পাওয়াও সম্ভব নয়।
অন্যদিকে অধিকাংশ বাংলা স্কুল, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্কুল ভগ্ন অবকাঠামো ও অনুপস্থিত শিক্ষক নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আর মাদ্রাসাজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন সাধারণ শিক্ষার অনুপাত বাড়লেও এর সত্যিকারের শিক্ষার চিত্র অত্যন্ত অস্পষ্ট। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৬০-এর দশকেই পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদদের মধ্যে এক রকমের তৎপরতা দেখা দিয়েছিল। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদেরা উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলায় পাঠ্যবই তৈরি করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমিসহ নানা প্রতিষ্ঠান এ কাজে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এ কাজ ক্ষীণ হয়ে গেছে। বিজ্ঞান, বাণিজ্য, এমনকি সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষকরাও ইংরেজিতে পড়ানো সহজ মনে করেন।