আগুন ঝরা ফাগুন

3

নিজস্ব প্রতিবেদক

উনিশশ’ সাতচল্লিশ সালের আগস্ট মাসে বৃটিশ শাসনের অবসানে ভারতবর্ষ প্রথম স্বাধীনতা লাভ করে পৃথক দুটি রাষ্ট্র হিসাবে। একটি ভারত, আরেকটি পাকিস্তান। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অখন্ড। অপর পক্ষে পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দু’টি জনপদ নিয়ে। হাজার মাইলেরও অধিক দূরত্বে অবস্থিত ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দু’টি জনপদ নিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, যা পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল, তার চারটি প্রদেশ ছিল- পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। আর পূর্বাঞ্চলে একমাত্র প্রদেশ ছিল, যার নাম ছিল পূর্ববাংলা। পূর্বাঞ্চলের এই একটি প্রদেশের জনসংখ্যা ছিল পশ্চিমাঞ্চলের চার-চারটি প্রদেশের সর্বমোট জনসংখ্যার চাইতেও অধিক। পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার সবাই ছিল বাংলাভাষী। এই নিরিখে বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি তোলা যেতো। তা অবশ্য তোলা হয়নি। তার জায়গায় উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালিয়ে দেয়ার একটা গোপন চক্রান্ত শুরু হয়। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষী অবাঙালিরা। সাধারণ ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে বিবেচনায় আনা হয়নি। পূর্ববঙ্গের পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য হিসাবে তার মাতৃভাষা ছিল উর্দু। তিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে সম্ভবত ধারণা দিয়েছিলেন যে, পূর্ববঙ্গের জনগণ সবাই উর্দু বোঝে। তিনি যদি জিন্নাহ সাহেবকে এই ভুল ধারণা না দিতেন, তাহলে জিন্নাহ সাহেবের মনে এমন একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হতো না যে, পূর্ব পাকিস্তানের সব লোক উর্দু বোঝে। জিন্নাহ সাহেব খাজা নাজিমুদ্দীনের কথায় বিশ্বাস করে তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে রেসকোর্স ময়দানে এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেন, যার ফলে নতুন করে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে মৃত্যু শয্যায় জিন্নাহ সাহেব তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহি বখসের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে বলেছিলেন, আমি অন্যের কথায় বিশ্বাস করে জীবনে বেশ কিছু ভুল করেছি। এর অন্যতম হলো আমার রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করা। এ বিষয়টা আমার গণপরিষদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল।