পূর্বদেশ ডেস্ক
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং দলটির নেতাদের বিচারে ‘গড়িমসি’র অভিযোগ তুলে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। দলটির আহব্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নৌকা মার্কাকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। বিচার চলাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে। খবর বিডিনিউজের
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশন ‘জনআকাঙ্খার পক্ষে কাজ করছে না’ বলেও অভিযোগ করেছে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতাদের সামনে রেখে গঠিত দলটি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গত একমাস ধরে ঢাকার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মশাল মিছিল করার পর শুক্রবার বিকালে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেইটে সমাবেশ করে এনসিপির ঢাকা মহানগর শাখা। গত ১৫ বছরে সেখানে কেবল আওয়ামী লীগকেই রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেখা যেত। এদিন এনসিপির হাজারো নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে এলাকাটি পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। নেতাকর্মীদের হাতে ছিল বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের পতাকা। বিকাল ৩টা থেকে শুরু হওয়া সমাবেশে এনসিপির প্রায় ২০ জন কেন্দ্রীয় নেতা বক্তব্য রাখেন। সন্ধ্যা নামার আগ মুহূর্তে বক্তব্য দিতে শুরু করেন আহব্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ৯ মাস পরেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আমাদেরকে রাজপথে নেমে আসতে হচ্ছে। এটা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা বলে মনে করি। জাতির কাছে আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিজম ও স্বৈরাচারের বিচার নিশ্চিত করা। বিচার সংস্কারের জন্য মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল। আজকের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে বলতে চাই, অবিলম্বে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে।
আওয়ামী লীগের সময়ের পরিস্থিতি তুলে ধরে নাহিদ বলেন, বিগত ১৬ বছরে তিন তিনটি ভোটকে কুক্ষিগত করে মানুষের ভোটাধিকারকে হরণ করেছে আওয়ামী লীগ। পিলখানা হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশকে পরাস্ত করেছিল। ২০১৩ সালের শাপলা হত্যাকান্ডের মাধ্যমে আলেমদের মত প্রকাশের অধিকারকে হরণ করেছিল। এছাড়া ধারাবাহিকভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন, মোদীবিরোধী আন্দোলনে দমন পীড়ন চালিয়েছে। জুলাই আন্দোলনে জনগণকে তারা এই দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনী, বিজিবিকে দিয়ে গুলি চালিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ এখন আর কোনো ‘রাজনৈতিক দল নেই’ মন্তব্য করে এনসিপি নেতা বলেন, তারা ফ্যাসিস্ট সংগঠনে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কোনো প্রশ্ন আর নেই। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে বিচার চলাকালীন সময়ে তার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে।
ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করে নাহিদ বলেন, দুঃখের বিষয় জুলাইয়ের শহীদ পরিবারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেওয়ার কথা ছিল। তাদের মর্যাদার জীবন নিশ্চিত করার কথা ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা করেনি। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদেরকে জামিন দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে তৃণমূলে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসিত হচ্ছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে এনসিপির আহব্বায়ক বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, সেই কমিশন গণহত্যাকারী, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের লোকদেরকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করতে সম্মতি দিচ্ছে না। অথচ নির্বাচন সংস্কার কমিশন সুস্পষ্টভাবে সুপারিশ করেছে যে, যারা গণহত্যা করেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা কোনোভাবেই আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই প্রস্তাবে সম্মত হচ্ছে না। আমরা সন্দেহ করছি, এই নির্বাচন কমিশন কার পারপাস সার্ভ করবে?
গণমাধ্যমের সমালোচনা করে নাহিদ বলেন, আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছে যে শেখ হাসিনা গণহত্যাকারী কি না? সেই সব সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে চাই- আপনারা সাংবাদিক নন, আপনারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর। জাতিসংঘের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে শেখ হাসিনার নির্দেশে, আওয়ামী লীগের পরিকল্পনায় জুলাই অগাস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে।
বক্তব্যের শুরুতে কয়েক মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশের শতবছরের ইতিহাসের একটি পাঠ তুলে ধরে নাহিদ ইসলাম বলেন, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের জন্য ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশের জনগণ রাজপথে নেমে এসেছে, জীবনদান করেছে, শাহাদাত বরণ করেছে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বঙ্গের বাঙালি মুসলমান নিম্নে বর্গের হিন্দুদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ধর্মীয় অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করেছিল। সেই লড়াইয়ের ফসল হিসাবে আমরা আমাদের এই সীমানা পেয়েছিলাম। যদিও সেই লড়াইয়ের লক্ষ্য ছিল সমগ্র বাংলার অখন্ডতা কায়েম করা। কিন্তু কলকাতার ব্রহ্মণ্যবাদী জমিদারদের ষড়যন্ত্রের কারণে সেই রাষ্ট্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে বার বার। সে কারণেই ৭১ সালে বাংলাদেশের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল।
নাহিদ বলেন, বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু ৭২ সালেই সোনার বাংলার স্বপ্ন মুজিববাদীদের হাতে বেহাত হয়ে গিয়েছিল। মুজিববাদীরা ৭২ এর সংবিধানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতীয় শাসক গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিল। মুজিববাদী সংবিধানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী মানুষের অধিকার ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামপন্থি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। সমাজতন্ত্রের নামে পুঁজির স্বাধীন বিকাশকে রক্ষীবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্রের নামে বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল।
অন্যদের মধ্যে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ, যুগ্ম সদস্য সচিব লুৎফর রহমান, যুগ্ম সদস্য সচিব নিজাম উদ্দিন, যুগ্ম সদস্য সচিব তারেক রেজা, যুগ্ম সদস্য সচিব আহনাফ সাইদ খান, দক্ষিণাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আতাউল্লাহ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক এসএম শাহরিয়ার বক্তব্য দেন।