ফারুক আবদুল্লাহ
গত ১৭ বছর ধরে যারা নির্বাচন ও সরকারকে মেনে নিতে পারেনি, তারাই আওয়ামী লীগের দোসরদের সঙ্গে নিয়ে ভোটবিহীন চট্টগ্রাম কাস্টম এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন আয়োজন করে নজির স্থাপন করেছে। এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখলে নিয়েছে আওয়ামী লীগের দোসরা। এদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে প্ল্যাটিনাম পাচার, টেস্ট রিপোর্ট জালিয়াতি ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনকে বৈধতা দিতে গুটিকয়েক শীর্ষ পদে বিএনপির নেতাকর্মীদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, একটি প্রভাবশালী মহল তফশিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন প্রভাবিত করার অপচেষ্টা চালায়। মনোনয়ন ফরম গ্রহণ ও মনোনয়ন জমাদানের সময় আগ্রহী প্রার্থীদের মারধর, হুমকি ও বাধা প্রদান করে ফরম কেড়ে নেওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে।
এদিকে অভিযোগের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম কাস্টম এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন তদন্তের জন্য শ্রম অধিদপ্তর থেকে দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করা হয়। কমিটিকে আগামী ১৭ ফেব্রæয়ারি বিকাল ৩টায় সরেজমিনে তদন্তের পর পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুস সাব্বির ভ‚ঁইয়া জানান, নির্বাচন তদন্তের জন্য একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। তবে সেটি প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
শপথের পরে তদন্তের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি প্রত্যাহার না হয় তাহলে তদন্তের জন্য শপথ স্থগিত করতে একটি নোটিশ জারি হতে পারে।
সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ ভোটররা ক্ষুদ্ধ হয়ে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার জুলাই-আগস্টের আকাঙ্খাকে পদদলিত করে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে বিএনপির উপরের মহলের দোহাই দিয়ে জোরপূর্বক সিলেকশন করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে কতিপয় পদবীধারী বিএনপি নেতা। বর্তমানে এ বিষয়ে দুজন প্রার্থী শ্রম অধিদপ্তরে অভিযোগ দিলে তা আমলে নিয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছেন। সাধারণ সিএন্ডএফ মালিকরা আশা করেন এই তদন্ত কাজ যেনো টাকার কাছে অথবা উপরের মহলের তদবিরে সত্যকে আড়াল করা না হয়।
যেখান থেকে ভোটবিহীন নির্বাচনের মূল পরিকল্পপনা :
এই পাতানো নির্বাচনের মূল পরিকল্পপনা হয় টেকনাফ উপজেলার আলোচিত সংসদ সদস্য ইয়াবা স¤্রাট বদির আত্মীয় ও আওয়ামী লীগের দোসর এলিট ট্রেডিং লিমিটেডের পরিচালক সিরাজুল মনোয়ারের নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থিত জীবন বীমা অফিস এবং আরবি কোর্ট অফিস থেকে। এখান থেকে নির্বাচনের সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পরিকল্পনায় আরো নেতৃত্ব দেন আওয়ামী টেন্ডার সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য শওকত আলী, আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আবছার, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা বাচ্ছুর সহযোগী সাইফুদ্দিন, রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবসার।
গুরুত্বপূর্ণ পদে আওয়ামী দোসররা :
সংগঠনের মোট ২৯টি পদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সবকটি পদ আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম সহ-সভাপতি পদে রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা মো. নুরুল আবছার। তার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ডোনার এবং তার ভাই ফারুক ঘোষাইলডাঙ্গা ও বন্দর এলাকার আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় নীতি নির্ধারক। দ্বিতীয় সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আলতাফ হোসেন বাচ্চুর দোসর মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। কমিটির শীর্য পদ সাধারণ সম্পাদক করা হয় টেন্ডার সম্রাট সিরাজুল মনোয়ারের সহযোগী আওয়ামী লীগ আমলের আরেক টেন্ডার সম্রাট, নোয়াখালির এমপি মোর্শেদ আলম ও সিডিএ চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের ঘনিষ্ট বন্ধু পরিচয় দানকারী শওকত আলী। সে গত ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আঁতাত করে সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের সিএন্ডএফ’র কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে এককভাবে করেছে এবং বড় বড় আওয়ামী লীগ নেতাদের সিএন্ডএফ কাজগুলো সে করেছে। কমিটির প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে মো. উবায়েদুল হক (আলমগীর), যে কিনা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে লাইসেন্সের মালিক হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। তার বিরুদ্ধে প্ল্যাটিনাম পাচার সহ শত কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে ইনকামের অভিযোগ রয়েছে। পরে বিষয়টি কাস্টমের অগোচরে আসলে তারা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং তার লাইসেন্সটি সাসপেন্ড হয়। পরে আলমগীর তখনকার সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চুর মাধ্যমে কাস্টমসের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লোকজনকে ম্যানেজ করে লাইসেন্সটি আবার সচল করে বলে অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে দ্বিতীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয় মো. জামাল উদ্দিন বাবলুকে। সে নোয়াখালী জেলার সেনবাগ থানার বিএনপি নেতা অথচ গত ১৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চুর কমিটিতে ছিল। তার ছত্রছায়ায় অবৈধ কার্যক্রমে লিপ্ত থেকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে টেস্ট রিপোর্ট জালিয়াতির কারণে যার লাইসেন্স সাসপেন্ড হয়েছিল, তার এ জালিয়াতি ধরার পর থেকে আড়াই হাজার সিএন্ডএফ মালিককে এখন বন্দর থেকে অনলাইনে টেস্টি রিপোর্ট সাবমিট করতে হয়। এতে সাধারণ মালিকের ভোগান্তি অনেক বেড়ে গেল। তার লাইসেন্সটিও আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু পরে কাস্টমসের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সচল করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
কাস্টমসবিষয়ক প্রথম সহ-সম্পাদক করা হয় চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক মনসুর উল আমিন রিয়াজকে। সে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ কমিটির নির্বাহী সদস্যও ছিল। জুলাই আগস্টের আন্দোলনে ছাত্রলীগের সবচেয় বড় ডোনার বলে জানা যায়। বন্দরবিষয়ক প্রথম সহসম্পাদক পদে লোকমান হোসেন (খন্দকার) আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। বন্দরবিষয়ক দ্বিতীয় সহ-সম্পাদক করা হয় এমএইএস কলেজ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তাজুল ইসলামকে। সে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা মোতালেব হোসেন বাদশার ব্যবসায়ীক পার্টনার ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মুসলিম উদ্দিনের বিশ্বস্ত সহচর। প্রচার ও দপ্তরবিষয়ক সম্পাদক পদে রয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদের ভাগিনা আহম্মদ শহিদ। সাংস্কৃতিক-শ্রম ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক পদে রয়েছে সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের ভাতিজা ও মোহরা আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল আজম খান। এছাড়া নির্বাহী সদস্য পদে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. মনিরুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগ সমর্থক মো. মেজবাহ উদ্দিনকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়।
তাছাড়া কমিটির শীর্য পদ সভাপতি হিসেবে রয়েছে নগর বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক এ এস এম সাইফুল আলম, তৃতীয় সহ-সভাপতি পদে বিএনপির সমর্থক আবু ছালেহ ছাড়াও জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের নেতারা বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
এদিকে সিন্ডিকেটের ভাগাভাগীকৃত ভোটবিহীন এই সিলেশনকে বাতিল করে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানান সাধারণ সিএন্ডএফ সদস্যরা।
ভুক্তভোগী নুরুল আবছার বলেন, ফরম নিয়েছিলাম, নির্বাচন যেহেতু হয় নাই তাই ফরম প্রত্যাহার করে নিলাম। আমরা মান সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। কেন প্রত্যাহার করলেন জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বলেন, আগামী ১৬ ফেব্রæয়ারি শপথ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর আমি আর সভাপতি নির্বাচনের সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে ব্রিফ করবো।
নির্বাচনে প্রার্থীদের নিয়ে নানা বিতর্কিত বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শপথ অনুষ্ঠানের পর সমস্ত কিছু অবহিত করবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. শরিফ ও কমিশনার মো. হানিফকে একাধিবার ফোন করে বলা সম্ভব হয়নি।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি এড. আখতার কবির চৌধুরী বলেন, বিগত ১৫ বছর ভোটারবিহীন নির্বাচন ছিল, রাতের অন্ধকারে নির্বাচন হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে ভোট মানে অনাস্থা, অনীহা ও আতংক ছিল। সেই জায়গায় ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানের মধ্য দিয়ে আকাংখা ছিল যে, মানুষের পরিবর্তন হবে, প্রত্যক জায়গায় গণতন্ত্রের চর্চা হবে। কিন্তু এসব না হয়ে ঠিক আমরা একটা বিপরীত চিত্র ভয়াবহ আকারে দেখতে পাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, পদ্ধতির কোন পরিবর্তন হয়নি, তবে কিছু মানুষের চেহারা পরিবর্তন হয়েছে। স্বৈরাচারী মনোভাব, আগ্রাসী আচরণ অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে- বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন, সেখানে আমরা সেটারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। যারা জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে এবং ত্যাগ স্বীকার করে কারাবরণ করেছে- টোটাল বিষয়ের সাথে আজকে যারা ক্ষমতার চর্চা করছে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন ২৬ ফেব্রুয়ারি হওয়ার কথা ছিল। মোট ভোটার ২ হাজার ৫০০ জন। এ জন্য গত ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও রবিবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল। এবারের নির্বাচনে ৭২ জন মনোনয়েন পত্র সংগ্রহ করলেও জমা দিয়েছেন ৫৯ জন। এর মধ্যে আটটি পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো না। কিন্তু মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে ৩০ জন মনোনয়ন প্রত্যাহার করলে কোন প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় অবশিষ্ট ২৯ জনকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়।