পূর্বদেশ ডেস্ক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা হারানোর আগে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সবক্ষেত্রে ‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ প্রতিষ্ঠা করে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল বুধবার ঢাকার তিন এলাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কুখ্যাতি পাওয়া তিনটি গোপন বন্দিশালা ঘুরে দেখে তিনি বলেছেন, আয়নাঘর তারই একটি নমুনা। দেশে আয়নাঘরের মত দৃষ্টান্ত হতে দেওয়া সবার অপরাধ।
ইউনূস বলেন, আইয়্যামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে, গত সরকার আইয়্যামে জাহেলিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে সর্বক্ষেত্রে। এটা তার একটা নমুনা। খবর বিডিনিউজের।
রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরা এলাকায় গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনের সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেই নির্যাতন পেরিয়ে বেঁচে ফিরে আসা কয়েকজন ভুক্তভোগী আর সাংবাদিকরা ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য এবং গুম তদন্ত কমিশনের সদস্যরাও এসময় তার সঙ্গে ছিলেন বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস থেকে জানানো হয়েছে।
প্রেস অফিস বলছে, প্রধান উপদেষ্টাকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের একটি নির্যাতনকেন্দ্রে ব্যবহৃত একটি বৈদ্যুতিক চেয়ার দেখানো হয়। একজন গুমের শিকার ব্যক্তি কচুক্ষেত এলাকায় প্রধান উপদেষ্টাকে নির্যাতন সেলের দেয়াল দেখান।আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিরোধী মতের বহু মানুষকে তুলে নিয়ে বিচার বহির্ভূতভাবে অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখার অভিযোগ ওঠে, সেইসব বন্দিশালার প্রতীকী নাম রাখা হয়েছে ‘আয়নাঘর’।
এ ধরনের বন্দিশালা দেশজুড়ে ‘আছে’ জানিয়ে ইউনূস বলেন, আমার ধারণা ছিল এটা মনে হয় এখানেই আয়নাঘর বলতে যে কয়েকটা আছে। এখন শুনতেছি আয়নাঘরে বিভিন্ন ভার্সন সারা দেশজুড়ে আছে। কেউ বলবে সাতশ’, কেউ বলবে আটশ’। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি এখন পর্যন্ত। কতগুলো জানা আছে, কতগুলো অজানা রয়ে গেছে। আইয়্যামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে, গত সরকার আইয়্যামে জাহেলিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে সর্বক্ষেত্রে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নৃশংস অবস্থা, যতটা শুনি অবিশ্বাস্য মনে হয়, এটা কি আমাদের জগৎ, আমাদের সমাজ! যারা নিগৃহীত হয়েছে, যারা এটার শিকার হয়েছে তারাও আমাদের সঙ্গে আছেন। তাদের মুখের থেকে শুনলাম কিভাবে হয়েছে, কোনো ব্যাখ্যা নাই। একটা ব্যাখ্যা থাকলে কিছু একটা হলে মানুষ বোঝে এটার কারণ ছিল, এটা বিনা কারণে, রাস্তা থেকে উঠিয়ে আনার মত। বিনা দোষে কতগুলো সাক্ষী-সাবুদ হাজির করে কতগুলো গাড়ির মধ্যে ঢুকায় দিয়া তারে বলছে তুমি সন্ত্রাসী-জঙ্গি, এগুলো বলে বলে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে।
তুলে নেওয়া সেসব মানুষদের কেউ কেউ বহু দিন পর পরিবারের কাছে ফিরে বীভৎস নির্যাতনের বিবরণ দিলেও অনেকের খোঁজ এখনও মেলেনি। বিভিন্ন বাহিনীর আওতাধীন এমন আয়নাঘরের সন্ধান পাওয়ার কথা বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ‘গুম তদন্ত কমিশন’।
গত ১৯ জানুয়ারি বৈঠকে কয়েকটি গুমের ঘটনার নৃশংস বর্ণনা প্রধান উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরা হয়। ছয় বছরের শিশু গুম হওয়ার ঘটনাও তদন্তে উঠে এসেছে বলে জানান কমিশন সদস্যরা।
গুম কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা বহু কষ্ট করেছে। অন্যান্য কমিশনতো করেছে অন্তত তারা নিজেদের ঘরে বসে করতে পেরেছে। গুম কমিশনকে এগুলো বের করতে আসতে হয়েছে। কিসের মধ্যে ঢুকিয়েছিল, কারা কি করেছে, এখনও ধ্বংসাবশেষ।
পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখানে ভুক্তভোগী, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। ভুক্তভোগীর সংখ্যা আমাদের জানা মতে সতেরশ প্লাস। অজানা কত এটাতো আমরা জানি না। কেউ কেউ বলে এটা তিন হাজারের বেশি হবে।
‘আয়নাঘর’ ও এর আনুসাঙ্গিক সামগ্রী প্রমাণ হিসাবে সিলগালা করে রাখা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিচারের কাজে যেন প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।
ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার জানিয়ে ইউনূস বলেন, আমরা দেখছি যে ন্যায় বিচারটা তার যেন হয়, অতি তাড়াতাড়ি হয়। বিচার দীর্ঘসূত্রিতায় পরে থাকবে, সে যেন নিস্কৃতি পায়, এটা আমাদের ফার্স্ট প্রেফারেন্স।
এ ধরনের ঘটনার যাতে কোনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিজ্ঞা বলে জানিয়েছেন ইউনূস।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন পর্যন্ত সময়ের ঘটনা গুম কমিশনের বিবেচনায় আনা হয়। কমিশন গত ১৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। পরদিন এ প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশও করা হয়।
‘গুমের’ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয় ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে।
সেদিন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর গুম বিষয়ক কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তারা মার্চে আরও একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেবেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন পড়বে।
প্রধান উপদেষ্টা গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনের সময় তার সঙ্গে ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।