আইয়ুব বাচ্চু, বাংলাদেশী সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক ছিলেন। তিনি রক ব্যান্ড এল আর বি এর গায়ক ও গীটারবাদক হিসেবে পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তাকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং গীটারবাদক বলা হয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।
বাচ্চু চট্টগ্রামে ১৯৭৬ সালে কলেজ জীবনে ‘আগলি বয়েজ’ নামক ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে তার সঙ্গীত জীবনের সূচনা করেছিল। ১৯৭৭ সালে তিনি “ফিলিংস” (বর্তমানে “নগর বাউল” নামে পরিচিত) এ যোগদান করেন এবং ব্যান্ডটির সাথে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। একই বছরে তিনি জনপ্রিয় রক ব্যান্ড সোলস-এর প্রধান গীটারবাদক হিসেবে যোগদান করেন। সোলসের সঙ্গে তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, সুপার সোলস (১৯৮২), কলেজের করিডোরে (১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এবং ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯৮৮) চারটি অ্যালবামে কাজ করেছিল। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল তিনি তার নিজের ব্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করে, যা পরবর্তীকালে লাভ রান্স বøাইন্ড নামে বা সংক্ষেপে এল আর বি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি তার মৃত্যু অবধি ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর ধরে ব্যান্ডটির সঙ্গে ছিলেন। একজন একক শিল্পী হিসেবেও তিনি সফলতা পেয়েছিল। তার প্রথম একক অ্যালবাম রক্ত গোলাপ, যা ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় অ্যালবাম ময়না (১৯৮৮) দিয়ে, তিনি তার একক কর্মজীবনের সফলতা অর্জন করেন এবং পরে কষ্ট (১৯৯৫) অ্যালবামটি প্রকাশ করেন, যা প্রচুর সফলতা অর্জন করে। ২০০৭ সালে তিনি দেশের প্রথম বাদ্যযন্ত্রগত অ্যালবাম সাউন্ড অফ সাইলেন্স প্রকাশ করেন।
বাচ্চু এল আর বি’র সাথে এবং একজন একক শিল্পী হিসেবে প্রচুর অ্যালবাম বিক্রয় করেছেন। বাচ্চু বাংলাদেশে একজন অন্যতম সেরা গীটারবাদরক এবং অন্যতম প্রভাবশালী গীটারবাদক। এল আর বি’র সাথে সে ছয়টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং একটি সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস জিতেছেন। ২০০৪ সালে বাচসাস পুরস্কার জিতেছিলেন সেরা পুরুষ ভোকাল বিভাগে। ২০১৭ সালে সে টেলে সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার জিতেছিলেন।
বাচ্চু তার বান্ধবী ফেরদৌস চন্দনা’কে বিয়ে করেছিলেন ১৯৯১ সালের ৩১শে জানুয়ারিতে। তাদের দু’টি সন্তান আছে। মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং ছেলে আহনাফ তাজওযার আইয়ুব। ছয় বছর ধরে ফুসফুসে পানি জমার অসুস্থতায় ভোগার পর ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঢাকায় তার নিজ বাসভবনে মারা যান। মৃত্যুর দুইদিন আগে তিনি রংপুরে তার শেষ কনসার্ট করেন।
তাকে চট্টগ্রামের চৈতন্য গলি’তে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে, তার মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইশহাক চোধুরী এবং মা নুরজাহান বেগম। তাদের পরিবার ছিল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। তার মতে তাদের পরিবারে সবাই ‘অতি ধার্মিক ছিলেন এবং সঙ্গীত নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা কেউ গ্রহণ করেননি।’ তারা তিন ভাই-বোন ছিলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের জুবীলি রোড এলাকায় একটি বাড়ি ক্রয় করেন, যেখানে বাচ্চুর বেশিরভাগ কৈশর জীবন অতিবহিত হয়। ১৯৭৩ সালে তার বাবা তাকে তার ১১তম জন্মদিনে একটি গীটার উপহার দেন। তার কৈশর জীবনের শুরুর দিকে সে বিভিন্ন ব্রিটিশ এবং আমেরিকান রক ব্যান্ডের গান শোনা শুরু করে, যেমন তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রক ব্যান্ড লেড জেপলিন, ডিপ পার্পল, কুইন, দ্য জিমি হেনড্রিক্স এক্সপেরিয়েন্স ইত্যাদি। তন্মধ্যে জিমি হেনড্রিক্স এর গীটার বাজানো তাকে বেশি মুগ্ধ করেছিল। তাকে গীটার শেখাতো জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ মানুষ যে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামে থাকতো। ১৯৭৬ এর দিকে সে তার এক বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে ইলেকট্রিক গীটার বাজাতো, যা ছিল একটি টিস্কো গীটার। পরে সে যখন গীটারটির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখান, তার বন্ধু তাকে গীটারটি দিয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালে তাকে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ১৯৭৯ সালে সে ওই স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। চট্টগ্রামে কলেজ জীবনে সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে তিনি একটি ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন। এর নাম ছিল “গোল্ডেন বয়েজ”। পরে নাম বদলে করা হয় “আগলি বয়েজ”। সেই ব্যান্ডের গায়ক ছিল কুমার বিশ্বজিৎ এবং বাচ্চু ছিল গিটারিস্ট। সেই সময়ে তারা মূলত পটিয়ায় বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানে গান গাইতো এবং শহরের বিভিন্ন ক্লাবে গান করতো। ১৯৮০ সালে বাচ্চু ও বিশ্বজিৎ যখন সোলসে যোগদান করে তখন ব্যান্ডটি ভেঙে যায়।
আইয়ুব বাচ্চুকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ১৮ ফুট উচ্চতার একটি গিটারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। রূপালী গিটার আইয়ুব বাচ্চুর একটি জনপ্রিয় গানের শিরোনাম অনুসারে এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয় রূপালী গিটার। চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন।
আইয়ুব বাচ্চুর ফুসফুসে পানি জমার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন (২৭ নভেম্বর, ২০১২)। সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হন।
বাচ্চু ১৮ই অক্টোবর ২০১৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। একই দিন সকালে অসুস্থবোধ করায় তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা ৯টা ৫৫ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সূত্র : উইকিপিডিয়া