গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে দেশের অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটিবন্ধ না করলে বিশৃঙ্খলাকারীরা সুযোগ গ্রহণ করবে। তিনি সকলপক্ষকে সাবধান করেননি শুধু, বারবার বলেছেন, ‘আমি আজকে বলে দিলাম, নইলে বলবেন সতর্ক করিনাই’। এর দুই দিন আগে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মধ্য রাতে সাংবাদিকদের ডেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দমনে কঠোর পদক্ষেপের কথা জানালেন। সেনাবাহিনীর প্রধান ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কত নাজুক অবস্থায় আছে। সরকার কয়দিন আগে ‘ডেভিল হান্ট অপারেশন’ নাম দিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু করেছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। দেশে-বিদেশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে খুনখারাবি, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, রাহাজানি, লুটতরাজের মতো ঘটনা। পথে-ঘাটে ছিনতাই, হাইজ্যাকের ঘটনার পাশাপাশি বাসা-বাড়ি, দোকানপাটে হানা দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। ফলে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তার অভাববোধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশজুড়ে একের পর এক নানা ধরনের অপরাধ ঘটে চলেছে। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি থেকে খুন, ধর্ষণও হচ্ছে অবলীলায়। সারা দেশে চলমান ‘ডেভিল হান্ট’ কর্মসূচির মধ্যেও থেমে নেই অপরাধচক্রের এসব অপকর্ম।
প্রকাশ্যে, জনারণ্যেও এসব ফৌজদারি অপরাধ ঘটছে। অপরাধীরা কাউকেই তোয়াক্কা করছে না; বরং দিনে দিনে তারাও আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অব্যাহত এমন কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। নেওয়া হচ্ছে নানামুখী পদক্ষেপ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে অভিযান আরো জোরদার করা হচ্ছে। অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে আরো টহল বাড়ানো হবে, চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হবে। আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোন কমিটির সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, সবাই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ‘সিরিয়াসলি’ নিয়েছেন। এতে ঢাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
সন্ধ্যার পর থেকে যৌথ প্যাট্রল শুরু হবে। ঢাকায় যেসব জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়ছে, সেসব জায়গায় প্যাট্রল বাড়বে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও নৌবাহিনীর যৌথ প্যাট্রল শুরু হবে। পুরো ঢাকা শহরে অনেক জায়গায় চেকপোস্ট (তল্লাশি চৌকি) বসবে। আইন-শৃঙ্খলা নজরদারি করা হবে। গোয়েন্দা সংস্থার অ্যাক্টিভিটিজ আরো বাড়ানো হবে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশে অনেক থানায় হামলা হয়। অস্ত্র, গোলাবারুদ লুট হয়। কয়েকটি কারাগারেও হামলা হয়। অস্ত্র লুটের পাশাপাশি অনেক জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি বের হয়ে যায়। দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতির পেছনে ওইসব সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে পুলিশ আশঙ্কা করছেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্র পুরোটাই উদ্ধার না হওয়ায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পুলিশের তথ্যমতে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গত ৫ ও ৬ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানা ও কারগারে হামলা চালিয়ে পিস্তল, রিভলবার, শটগানসহ ১১ ধরনের পাঁচ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে চার হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র গতকাল পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৩৮৪টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের মধ্যে এখনো ১২ জন গ্রেপ্তারের বাইরে রয়েছে।
আমরা প্রথম থেকে বলে আসছি, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। মানুষ নিরাপদে থাকতে চায়, মানসম্মান নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে চায়। জনগণের চাহিদার ও নিরাপদ জীবনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কাজেই সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম গতিশীল ও স্বাভাবিক করতে হবে। যৌথ অভিযানের পরিধি আরো বাড়াতে হবে। নিরাপদে এবং মানসম্মান নিয়ে বসবাস করা মানুষের মৌলিক অধিকার। আমরা চাই, দ্রুততম সময়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হোক। পুলিশি কার্যক্রম জোরদার করা হোক। তবে অতীতের মত রাজনৈতিক সরকারের ন্যায় নিরাপরাধ কোন নাগরিক যেন ভোগান্তিতে না পড়ে সেই দিকেও নজর দিতে হব। ইতোমধ্যে ডেভিল হান্ট অপরারেশন নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে ব্যাপক। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর হবে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনবে। এছাড়া সম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন নতুন সংগঠন করার ক্ষেত্রে যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে তা মোটেই কাম্য নয়। এতে দেশের মানুষের হতাশার জাল আরো বিস্তৃত হবে। সেনাপ্রধান যে কথাটি বলতে চেয়েছেন, সেটি উপলব্ধি করেই সকল পক্ষের উচিৎ হানাহানি বন্ধ করা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের নিয়মে কাজ করা সুযোগ করে দেয়া।