পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষ আশা করেছিল এবার কিছুটা হলেও শান্তি পাওয়া যাবে, স্বস্তিতে দিন কাটবে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, নিরপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক ভর করছে মানুষের কাধে। নদী ও সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে শুরু করে ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি, হত্যা ও চাঁদাবাজির ঘটনায় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। সেই সাথে গুপ্ত হত্যা, ছিন্তাই ও আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় বিরোধ, রাজনৈতিক আধিপত্য ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে গুম, খুনের ঘটনাও এখন নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিনত হয়েছে। চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকা শহর ও আশে পাশের মফস্বল শহরে এমনকি এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এখন সন্ত্রাসীরা তৎপর। টঙ্গী তবলিগ জামাতের ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের এক ভয়াবহ সংঘর্ষে ৩ জনের প্রাণ সংহারের ঘটনায় ধর্মীয় অঙ্গনেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সব মিলে দেশের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। তদুপরি যারা আইন-শঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করার কথা সেই পুলিশের তৎপরতা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে দুর্বল বললে অত্যুক্তি হবে না। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর পুলিশ ও থানা সমূহের উপর যে ঝড় বয়ে গিয়েছিল, তার ক্ষত এখনও পুরাপুরি না শুকানোর কারণ কি না, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা বাহিনী ও বিজিবির টহল দেখা গেলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন, অভিজ্ঞ মহল। এ অবস্থায় সরকারের উচিৎ আইন-শৃঙ্খলা পরস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পুলিশ সদর দপ্তরের বরাতে যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে তা প্রনিধান যোগ্য। এতে বলা হয়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে দস্যুতার মামলা হয়েছিল ২১২টি। চলতি বছর হয়েছে ২৩১টি। চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে তিন হাজার ৮০৪টি হত্যাকাÐ হয়েছে। এর মধ্যে ডিএমপিতে ৫১৪টি হত্যা মামলা হয়। চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে হত্যা মামলা হয় দুই হাজার ২৭১টি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চলতি বছরের নভেম্বরে রাজধানীতে ২৭টি ও অক্টোবরে ২১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে ৪৭টি খুনের ঘটনা ঘটে। গত সোমবার চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে নোঙর করা সারবোঝাই একটি কার্গো জাহাজ থেকে সাতজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ। এ সময় আরো তিনজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে দুজন মারা যান। এসময়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা একদল কিশোরের ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা। গত বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জে ব্যাংকে ঢুকে কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ১৮ লাখ টাকা ডাকাতির চেষ্টায় তিনজনকে ঈ্রপ্তোর করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এছাড়া ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত এমন অনেকের অপহরণ, গুপ্ত হত্যার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। দেশে খুন, ডাকাতি, দস্যুতা বেড়ে যাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে, ধর্মীয় অঙ্গনে অস্থিরতা। গত ১৭ ডিসেম্বর টঙ্গীতে সংঘটিত ইজতেমার মাঠে মাওলানা জুবায়ের ও সাদ পন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হত্যাকান্ড আতঙ্কেও ডালপালা ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবওে দেখা যাচ্ছে, বালুর মহাল, লেক, নদী, খাল ,বিল বা খোলা মাঠ থেকে উদ্ধার হচ্ছে লাশ। এসব ঘটনায় যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান, র্যাব-পুলিশের তৎপরতাও কাজে আসছে না।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বর্তমান আইন-শৃঙ্খলার যে অবনতি লক্ষ করা যাচ্ছে, তা কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়। দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এক নায়কতান্ত্রিক শাসন শোষন থেকে মুক্তির আশায় ছাত্র জনতার জুলাই বিপ্লবে স্বতস্ফূর্ত সমর্থন যুগিয়েছিলেন। বিপ্লব পরবর্তীতে আশায় বুক বেঁধেছিলেন শান্তি, সম্প্রীতি ও সাম্যেও বাংলাদেশ দেখার। কিন্তু গত ৫ মাস প্রায় অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশ চালাচ্ছেন, কিন্তু বাজার দও থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা কোথাও স্বস্তি মিলছেনা। আমরা মনে করি, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। জনজীবনের নিরাপত্তা ও সইস্ত ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। আইনের শাসন ও সুবিচারের মাধ্যমে দুষ্কৃতকারী ও অপরাধীর যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের আন্তরিকতা। তারা আন্তরিক হলে অপরাধ দমন অনেক সহজ হয়ে যাবে। এর সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সরকার সংস্কারসহ নানা বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী-এটি আমরা বুঝতে পারি, প্রয়োজনও বটে। তবে জননিরপত্তার বিষয়টি অগ্রধিকার দেয়া এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।