গতকাল রবিবার বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে উদযাপিত হয়েছে বুদ্ধ পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব এটি। এই দিনটি বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক মহামতি গৌতম বুদ্ধ বা সিদ্ধার্থের জীবনের তিনটি ক্ষণের স্মৃতিতে ঘেরা। সিদ্ধার্থের জন্ম, বোধিলাভ ও মহাপ্রয়াণের সেই তিন ক্ষণ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে হয়েছিল বলে একে বৈশাখী পূর্ণিমাও বলা হয়।
চাঁদের হিসাব, গতকাল রবিবার (১১ মে) ছিল শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বৈশাখের এমনই পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের লুম্বিনী কাননে রাজা শুদ্ধোধন ও রানি মায়াদেবীর গৃহে জন্ম হয়েছিল এক শিশুর। সিদ্ধি লাভ করবেন এমন ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়ে সাধকেরা তার নাম দেন সিদ্ধার্থ।
যৌবনে ঠিক এমনই এক পূর্ণিমা তিথিতে কেবল সিদ্ধি নয়, ভারতের বিহার রাজ্যের বুদ্ধগয়ায় বোধিপ্রাপ্ত হন সিদ্ধার্থ। নিজের অন্তর্দৃষ্টির কথা সবাইকে জানিয়ে জাগতিক সকল সত্তাকে পুনর্জন্ম ও দুঃখের সমাপ্তি ঘটাতে সাহায্য করার সম্পূর্ণ বুদ্ধত্ব অর্জন করেন। আবার ৮০ বছর বয়সে এমনই এক পূর্ণিমা তিথিতে জাগতিক মায়া ত্যাগ করে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন তিনি।
বৈশাখের সেই পূর্ণিমা তিথি ফের এসেছে ধরায়। বোধিপ্রাপ্ত সেই মহাপুরুষ গৌতম বুদ্ধের ত্রিস্মৃতিবিজড়িত হওয়ার কারণেই এটি বুদ্ধ পূর্ণিমা নামেই পরিচিত। সে কারণেই সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ তার বোধিলাভের পর মানবতার যে ধর্ম প্রচার করেন, সেই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের এটিই পবিত্রতম উৎসব।
শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে রবিবার ছিল সরকারি ছুটি। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড.মোহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস তাঁর শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। হাজার বছর ধরে এদেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশ সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মহামতি গৌতম বুদ্ধ হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে মানবজাতিকে আলোকিত করেছেন। মানুষের মধ্যে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় গৌতম বুদ্ধ অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। তিনি বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের ভাগ্য উন্নয়ন এবং সমান অধিকার সুনিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। বুদ্ধের আদর্শের অনুসরণ হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়তে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীগণ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে বহু বছর ধরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে সমানভাবে অংশগ্রহণ করে আসছেন। গৌতম বুদ্ধের আদর্শ লালন করে দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় বাংলাদেশকে একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টা বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করেন।
সিদ্ধার্থের জন্মের পরপরই ঋষি অসিত জানিয়েছিলেন, রাজা শুদ্ধোদনের এই পুত্র ভবিষ্যতে রাজচক্রবর্তী সম্রাট (সব রাজ্যের একাধিপতি) হবে, অথবা সারাবিশ্বকে জয় করে নেওয়ার মতো সন্ন্যাসী হবে। একমাত্র সন্তান যেন সন্ন্যাসে না ঝুঁকে পড়ে, সে কারণে প্রাচীরঘেরা প্রাসাদে তাকে বড় করেন শুদ্ধোদন। কিন্তু সিদ্ধার্থের গন্তব্যই ছিল বোধি। ভোগবিলাসে তাই একসময় বৈরাগ্য আসে তার। জন্ম ও জগতের স্বরূপ উন্মোচন করতে আচমকা এক রাতে স্ত্রী যশোধরা ও সদ্যোজাত সন্তানকে ছেড়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। সাধনায় রত হন। এক অশ্বত্থ গাছের তলায় টানা ৪৯ দিন ধ্যান করে লাভ করেন সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান বোধি।
গৌতম বুদ্ধ তার বোধিপ্রাপ্তির পর অষ্টাঙ্গিক মার্গের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মানুষকে। জানান এই আটটি নীতি পালন করা গেলে দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণা কখনো কাউকে গ্রাস করতে পারবে না। গৌতমের সেই অষ্টমার্গ হলো সম্যক দৃষ্টি বা জীবন সম্পর্কে সৎ ধারণা, সম্যক সঙ্কল্প বা সৎ জীবনযাত্রা, সম্যক বাক্য বা সর্বদা সত্য কথা বলা, সম্যক আচরণ বা অন্যকে দুঃখ না দেওয়া, সম্যক জীবিকা বা সৎ পথে অর্থোপার্জন, সম্যক প্রচেষ্টা বা লোকের ভালো করার প্রয়াস, সম্যক স্মৃতি বা সৎ চিন্তা এবং সম্যক সমাধি বা কাজে মনোযোগ।
মানুষে মানুষে সমানাধিকার, সার্বিক কল্যাণ আর সেবার নীতি নিয়ে গৌতম বুদ্ধের মন্ত্র ছিল ‘অহিংসা পরম ধর্ম’। সেই মন্ত্র আর অষ্টমার্গের মর্মবাণী ধারণ করে মানুষ আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠবে, মানুষে মানুষে হানাহানি বন্ধ হয়ে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হবে বুদ্ধ পূর্ণিমায় সেই দর্শনটুকু ছড়িয়ে পড়ুক মানুষের মাঝে।