গত এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে উৎপাদনমুখী বা মেনুফ্যাকচারিং শিল্পের অবদান তার আগের দশ বছরের তুলনায় কমার তথ্য এসেছে পরিসংখ্যান ব্যুরোর অর্থনৈতিক শুমারিতে। ২০২৪ সালের শুমারির প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে শিল্প খাতের অবদান ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
গতকাল বুধবার বিকালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অডিটরিয়ামে ‘অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতি দশ বছর পর পর এ ধরনের শুমারি করে থাকে সরকার।
জরিপে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট ঠিকানায় ব্যবসা পরিচালনাকারীদের বলা হচ্ছে স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিট, ফুটপাথে বা হাঁটবাজারে অস্থায়ী উপায়ে ব্যবসা পরিচালনাকারীরা হচ্ছে অস্থায়ী বা সাময়িক অর্থনৈতিক ইউনিট। আর কৃষিকাজ ছাড়া বাসাবাড়িতে অন্য যেসব উৎপাদন ও সেবা পরিচালিত হয় সেগুলোকে বলা হচ্ছে অর্থনৈতিক খানা। এই তিন ধরনের কর্মকান্ডকে বলা হচ্ছে অর্থনৈতিক ইউনিট। খবর বিডিনিউজ’র
প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে। এরমধ্যে স্থায়ী ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ২১৪টি, অস্থায়ী ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬২১টি এবং অর্থনৈতিক খানা ৫০ লাখ ১২ হাজার ৫২৯টি।
অর্থনৈতিক ইউনিটের মধ্যে শহরাঞ্চলে ২৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ (৩৫ লাখ ৩১ হাজার ২০৩টি), গ্রামীণ অর্থনীতি ৭০ দশমিক ২৭ শতাংশ (৮৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৬১টি) রয়েছে। অর্থাৎ শহরের তুলনায় শহরের বাইরে অর্থতৈতিক কর্মকান্ড বেশি হচ্ছে।
শুমারির প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে মোট এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি অর্থনৈতিক ইউনিটে যুক্ত আছেন ৩ কোটি ৭ লাখ ৬১ হাজার ৩৪ জন মানুষ। এর মধ্যে পুরুষ ২ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ২৯৮ জন (৮৩.৩২ শতাংশ), নারী ৫১ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৭ জন (১৬.৬৭ শতাংশ) এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর ২ হাজার ৫৯ জন (০.০১ শতাংশ)।
স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটে যুক্ত আছে ২ কোটি ৩৭ লাখ ১৫ হাজার ৫৮২ জন (৭৭.১০ শতাংশ), অস্থায়ীভাবে যুক্ত আছে ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৪৬৭ জন (২.৫৮ শতাংশ), অর্থনৈতিক খানায় যুক্ত আছে ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৮৫ জন (২০.৩২ শতাংশ)।
গত তিনটি অর্থনৈতিক শুমারি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৩ সালে মোট ৩৭ লাখ ৮ হাজার ১৪৪টি অর্থনৈতিক ইউনিট থাকলেও ২০১৩ সালে তা ১১০ শতাংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি হয়।
আর সবশেষে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি হওয়ায় বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫২ শতাংশে।
২০০৩ সালে যেখানে এক কোটি ১২ লাখ ৭০ হাজার ৪২২ মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন, ১০ বছর পর তা ১১৭ শতাংশ বেড়ে দুই কোটি ৪৫ লাখ ৮৫০ জনে দাঁড়ায়। আর সবশেষ ২০২৪ সালের জরিপে পাওয়া যায় তিন কোটি সাত লাখ ৬১ হাজার ৩৪ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য। অর্থাৎ এখানে বেড়েছে ২৫ শতাংশ।আর কী জানা গেল?
শুমারির ফলাফলে দেখা যায়, ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক খানা ছিল ২৮ লাখ ২১ হাজার ৫৭১টি, আর গত ২০২৪ সালে অর্থনৈতিক খানার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ লাখ ১২ হাজার ৫২৯টিতে। বৃদ্ধির হার ৭৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে। এতে বোঝা যাচ্ছে গৃহকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গত ১০ বছরে বেশ বেড়েছে।
২০২৪ সালের শুমারির প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে চাকরিরতদের মধ্যে নারীর হার এখন ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ৭ দশমিক ২১ শতাংশ।
এই দশকের মধ্যে সেবাখাতেও ব্যাপক প্রতিষ্ঠানিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১৩ সালে সেবাখাতের প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৯ লাখ ১৫ হাজার ৯৮২টি, এক দশকে তা ৯১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে এক কোটি ৮ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৬টি।
এই দশকে গ্রামীণ অর্থনীতিও বেশ ভালো করেছে। ২০২৪ সালের শুমারিতে দেখা যায়, মোট অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর মধ্যে গ্রামীণ অর্থনীতি ৭০ দশমিক ২৭ শতাংশ আর শহুরে অর্থনীতি ২৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
দেশের প্রথম অর্থনৈতিক শুমারি ১৯৮৬ সালে হয়, এরপর দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শুমারি ২০০১ এবং ২০০৩ সালে পর্যায়ক্রমে হয়। তৃতীয়য় অর্থনৈতিক শুমারি হয় ২০১৩ সালে। এর ধারাবাহিকতায়, ২০২৪ সালের ১০-২৬ ডিসেম্বর দেশের চতুর্থ অর্থনৈতিক শুমারি হয়।
জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “অর্থনৈতিক শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। এই প্রতিবেদন নীতিনির্ধারক, গবেষক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অ্যাকাডেমিশিয়ান,তাদের প্রয়োজন মাফিক ভবিষ্যৎ নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমিকা রাখবে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুমারির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন এবং সেবা খাতের হালনাগাদ তথ্য জানা যাবে।”
মন্ত্রণালয় গঠিত বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল পুনঃনির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভাপতি কেএএস মুর্শিদ বলেন, অর্থনৈতিক শুমারি আমাদের জন্য একটি মূল্যবান তথ্যভান্ডার। এটি কেবল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের চিত্রই তুলে ধরে না, বরং শহর ও গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে শিল্প ও সেবা খাতে কর্মরত জনবলের সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা কাঠামো, উৎপাদিত পণ্য ও সেবার বৈচিত্র্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পন্ন খানার তথ্য জানা যাবে। এটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির গতিধারা নির্ধারণে সহায়ক হবে।
বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার ভিত্তি শক্তিশালী করবে। এই শুমারির মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য কেবলমাত্র নীতিনির্ধারকদের জন্য সহায়ক হবে না, বরং গবেষক, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেবে।