অবহেলিত শিক্ষকদের প্রতি নজর দিন

1

দেশের সবকটি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট কর্মপরিধির বাইরে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও নগরবাসীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছিয়ে দেয়ার কারণে। ১৯২৭ সালে তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান নুর আহমদের হাত ধরে চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নগরীতে অবৈতনিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সূচনা ঘটে। সেই থেকে সুদীর্ঘ একশো বছর ধরে নগরীর ৬০ লাখের অধিক নাগরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে আসছে। আর নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ড এ শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। উল্লেখ্য যে, সুদুর অতীত থেকে চট্টগ্রামের মানুষের জীবন ছিল কৃষি ও ব্যবসা নির্ভর। তবে নগরবাসীর বড় একটি অংশ ছিল ব্যবসায়ী। কারণ চট্টগ্রাম ছিল ভারত উপমহাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। আরব-আজম থেকে প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে বহিঃবিশ্বের ব্যবসায়ীরা আসা যাওয়া করতেন। সংগতকারণে তাদের সংস্পর্শে এ এলাকার মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। দেশি-বিদেশিদের কেনাকাটায় চাকতাই-খাতুনগঞ্জ, বক্সিরহাট, টেরিবাজার, রিয়াজুদ্দিন বাজারের গোড়া পত্তন ঘটে এ সময়। মোগল -ব্রিটিশ যুগে ফারসি ভাষার প্রচলন ছিল বেশি। ফলে তখন কেনাকাটাকে ‘সওদা’ বলা হতো। এ সওদা থেকে ‘সওদাগর’ শব্দের উৎপত্তি ঘটে। ইতিহাস বলে তৎকালিন চট্টগ্রাম নগরীতে যারা সওদাগর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাদের অধিকাংশের একাডেমিক শিক্ষা ছিলনা। এ সুযোগে বেনিয়া ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামবাসীতে অনেকটা ঠকিয়ে ব্যবসা বাগিয়ে নিতেন। ব্রিটিশ শাসকরা এক্ষেত্রে আরো কয়েকধাপ এগিয়েছিল। এ অবস্থা দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন নুর আহমদ চেয়ারম্যান। তিনি ব্যবসায়ী বাবা আমজাদ আলী সওদাগরের একমাত্র সন্তান ছিলেন বটে, বাবার ইচ্ছায় তিনিই সম্ভবত প্রথম নগরবাসী যিনি শিক্ষার সকল শাখায় প্রথম স্থান অধিকার করে ক্রমান্বয়ে কালকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রিসহ বিএল (আইন) ডিগ্রি অর্জন করেন। বাবার ব্যবসা বাদ দিয়ে প্রথমে আইন পেশা পরে রাজনীতি ও সমাজসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। ১৯১৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার নিযুক্ত হন এবং পর পর ৩ বছর তিনি এই পদে বহাল থাকেন। এরপর ১৯২১ সালে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখনকার সময়ে তিনি খুব কম বয়সে পৌরসভার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘ তেত্রিশ বছর টানা তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে সম্মানজনক দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, নুর আহমদ চেয়ারম্যান নগরবাসীর বাস্তবতা উপলব্ধি করে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী সকল শিশু, কিশোর -কিশোরীর স্কুলে ভর্তি ও স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এমনকি বিদ্যালয়ে সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকাÐ সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিশেষ টিম বা পরিদর্শক নিযুক্ত করা হতো, তারা সময়ে সময়ে স্কুল পরিদর্শনে যেতেন এবং কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে তা যথাসময়ে কর্তৃপক্ষ শোকজ করে অনিয়মের বিষয়টি দ্রæত নিষ্পত্তি করতেন। মাঝে মাঝে নুর আহমদ চেয়ারম্যান নিজেও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে যেতেন এবং বিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতেন। ওই সময় চট্টগ্রাম নগরে শিক্ষিতের হার ছিলো অবিভক্ত বাংলায় সর্বোচ্চ। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে এ বিষয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের অধিবেশনে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের রিপোর্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া যায়। পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরে শিশু মঙ্গল ও মাতৃসদন স্থাপনের ক্ষেত্রে নুর আহমদ চেয়ারম্যানের প্রশংসনীয় উদ্যোগ খুবই উল্লেখযোগ্য। প্রতিবন্ধী বালক-বালিকার জন্য চট্টগ্রামে একটি সেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর জোরালো ভূমিকা ছিলো। ১৯৩৮সালে চট্টগ্রামের ক্রীড়া জগতের সার্বিক উন্নয়নকল্পে নুর আহমেদের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রাম এথলেটিক ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রামের পল্লী অঞ্চলে দাতব্য চিকিৎসালয় বাড়ানোর জন্য তিনি তৎকালীন সরকারের নিকট দাবি জানিয়েছিলেন।অর্থাৎ চট্টগ্রামের মানুষের সকল প্রকার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি খুবই উদগ্রীব ছিলেন। নগরবাসীর জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর অবিরাম প্রচেষ্টা আজও স্মরণীয়।
১৯৫৪ সালে নূর আহমদ চেয়ারম্যান স্বেচ্ছায় পৌরসভার সর্বোচ্চ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি যখন অবসরে যাচ্ছিলেন তখন নগরীতে প্রাথমিক ও জুনিয়র (বাংলা-ইংরেজি) স্কুল গড়ে উঠেছিল চল্লিশের অধিক। আশার কথা চেয়ারম্যান নুর আহমদের মৃত্যুর পরও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের এ যাত্রা থামেনি। ১৯৭১সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৩-৭৪ সালে সবকটি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হলেও জুনিয়র ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো সিটি কর্পোরেশন পরিচালনা করতে থাকে। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্পোরেশন পরিচালনা করত। ক্রমান্বয়ে তা সম্প্রসারণ হয়ে বর্তমানে ৪৮টি মাধ্যমিক, ২৪ টি কলেজ, ১টি বিশ্ববিদালয়সহ প্রাইমারি, কিন্ডার গার্টেন, কম্পিউটার ইনস্টিটিউট, ফেরকানিয়া মাদ্রাসা, সাংস্কৃতিক টোলসহ ৩৮০টির মত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে চসিক। আগের চেয়ারম্যান, প্রশাসক ও মেয়রদের ধারাবাহিকতায় বর্তমান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে মনোযোগী হয়েছেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার শুরু থেকে এ দুটি বিভাগের মানোন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা ইতোমধ্যে সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে মেয়র বন্দর থেকে যে ১০০ কোটি টাকার পৌরকর আদায় করেছেন তা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়নে ব্যয় করার ঘোষণা দিয়েছেন।
সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারে চসিকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের বড় একটি অংশ অস্থায়ী নিয়োগ। যাদের অধিকাংশের চাকরির বয়স ১০ বছর থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত। এসব শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা এতোই অপ্রতুল যাদের এই শহরে পরিবার নিয়ে বাস করা কষ্টসাধ্য। জানা যায়, সম্প্রতি মেয়র শিক্ষকদের স্থায়ী করণের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা আশা করি, মেয়র মহোদয়ের এ উদ্যোগ শিগগিরই বাস্তবায়ন হবে। তবে এক্ষেত্রে যেন নতুনভাবে কেউ বৈষম্যের স্বীকার না হয়-সেই দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। আরবান হেলথ থেকে যাদের কলেজ ও স্কুলে যুক্ত করা হয়েছে এবং যেসব স্কুল-কলেজের প্রধানগণ দীর্ঘদিন ধরে অস্থায়ীভাবে কর্মরত আছেন তাদের প্রতি এবং ১২-থেকে ১৬ বছর অতিক্রম হওয়া কলেজ শিক্ষকদের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি, সহকারী শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল প্রদান এবং অবসরপ্রাপ্তদের আনুতোষিক প্রদানে মেয়র মহোদয়ের বিশেষ নজর থকেবে-এমনটি প্রত্যাশা নগরবাসীর।