আকতার কামাল চৌধুরী
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে এক আকষ্মিক চোখ ধাঁধানো হামলা চালায়। এই হামলায় ১২০০ ইসরায়েলীকে হত্যা, আরও ২৫১ জনকে ধরে নিজেদের ভূখÐে নিয়ে আসে হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ইসরায়েল প্রথমে হতবুদ্ধি হলেও পরে আকাশ পথে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। এ আক্রমণ সামান্য প্রতিরোধ করতে পারলেও মোটাদাগে কুপোকাত হতে থাকে হামাস। একসময় ইসরায়েল স্থলযুদ্ধ শুরু করলে অগুনতি ফিলিস্তিনির মৃত্যু আর ব্যাপক ধ্বংসলীলা শুরু হয় গাজা জুড়ে। যুদ্ধের ভয়াবহতায় পুরো গাজা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। বাস্তুহারা হয় ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি। এরমধ্যে দু-দুবার যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কিছু ইসরায়েলী জিন্মি আর বেশকিছু ফিলিস্তিনির মুক্তি ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই হয়নি।
এদিকে ফিলিস্তিনির প্রাণপুরুষ ইসমাইল হানিয়াসহ প্রথম সারির প্রায় সকল হামাস নেতার মৃত্যু, ক্রমাগত অচিন্তনীয় ধ্বংসলীলায় চরম কোণঠাসা হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কাতারের মধ্যস্থতায় কয়েকবার যুদ্ধবিরতির কাছাকাছি পৌঁছানো গেলেও স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানো যাচ্ছিল না ইসরায়েলকে। তারা সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হয় (তাদের) সমস্ত জিন্মি মুক্তির শর্তে। কিন্তু হামাস বুঝে যায়, ইসরায়েল তার জিন্মিদের মুক্ত করতে পারলে এ যুদ্ধ প্রলম্বিত করবে। তখন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঙ্কার ছাড়েন- ‘হামাসের উচিত হয়নি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আক্রমণ করা। তাঁর অভিষেকের আগেই যদি আটক জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়া হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে জাহান্নাম ফেটে পড়বে’। এ-লক্ষ্যে স্টিভ ইটফকে উভয় পক্ষের সাথে যোগাযোগের জন্য বিশেষ দূত করেও পাঠান ট্রাম্প।
অবশেষে চুক্তি, বহুল প্রত্যাশিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি, গাজাবাসীর স্বস্তির চুক্তি। এই চুক্তিতে শর্তের মধ্যে রয়েছে, গাজা উপত্যকা থেকে ধীরে ধীরে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হবে এবং হামাসের হাতে আটক বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। প্রথম ধাপে ৩৩ জন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেবে হামাস, যাদের মধ্যে সব নারী, শিশু ও ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষরা রয়েছেন।
চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ কার্যকরের বিষয়ে আলোচনা প্রথম ধাপের ১৬তম দিবসের মধ্যে শুরু হবে। সেখানে অবশিষ্ট সব ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
তৃতীয় ধাপে অবশিষ্ট মৃতদেহগুলোর ফেরত দেয়া এবং গাজা পুনর্গঠনের কাজ শুরুর কথা রয়েছে। এই কাজ মিশর, কাতার ও জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হবে।
এ যুদ্ধবিরতির সফলতা নিয়ে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করেন তিনিই গত বছরের মে মাসে এ প্রস্তাব করেছিলেন। পরিশেষে সেই প্রস্তাব-ই আজ বাস্তব রূপ লাভ করেছে, অন্যদিকে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, ‘নির্বাচনে তাঁর ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলেই গাজায় ‘মহাকাব্যিক’ যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে’। এ সফলতার দাবিদার যারাই হোক, গাজা যুদ্ধ হামাসকে সর্বস্বান্ত করে ফেলেছে। এ যুদ্ধে ৪৭ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ১লক্ষ ১০ হাজারের মতো। পুরো গাজা শহর মিশে গেছে মাটির সাথে। ধারণা করা হয়,প্রায় ১১ হাজার ফিলিস্তিনির দেহ চাপা পড়ে আছে ধ্বংসস্তুপের নিচে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এই ক্ষত কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্যই বলতে হবে। বলতেই হবে, এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে আরও দুর্বিনীত দৈত্য বানিয়ে দিয়েছে। তাদের একক সাফল্য লেবানন, ইরান, সিরিয়া আক্রমেনও প্ররোচীত করেছে। যুদ্ধবিরতির খবরে গাজা জুড়ে বাঁধভাঙা উল্লাস চলছে। এ উল্লাস হয়তো এ কারণে যে, ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যা থেকে আপাতত রক্ষা পাওয়া গেল। তাই এ উল্লাস যত না যুদ্ধবিরতির, তার চেয়েও বেশি জীবন বাঁচানোর।
লেখক : প্রাবন্ধিক