সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
আরবী বছরের প্রথম মাস মুহররম। আরবী বারটি মাসের মধ্যে যে চারটি মাসকে ‘আশহুরুল হুরুম’ তথা পরম সম্মানিত মাস হিসেবে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ ঘোষণা করা হয়েছে, মুহররম মাস এ চতুষ্টয়ের অন্যতম। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন: “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। (সূরা আল-তাওবাহঃ ৩৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বারো মাসে বছর, তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।
তিনটি ধারাবাহিক: যিলক্বদ, যিলহজ্ব, মুহররম। আর চতুর্থটি হল রজব; যা জুমাদা আল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস। (বুখারি-২৯৫৮, মুসলিম-১৬৭৯)
আসমান-যমীন সৃষ্টিকাল হতেই এ মাসটি বিশেষভাবে সম্মানিত হয়ে আসছে। এ মাসের ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন: “মুহররম মাস হচ্ছে সমস্ত মাসের সরদার।” (ফাতহুল বারী: ৪/৭৭০, কাশফুল খিফা-১/৪৫৯)
এ মাসেরই দশ তারিখ অর্থাৎ ১০ই মুহররম ‘আশূরা’র দিন, মুহররম মাসের শ্রেষ্ঠতম দিন। দিনটি বিশ্বব্যাপী এক আলোচিত দিন।
আশূরার নামকরণ: আ’শুরা ও তাসূয়া’ দুটি প্রসিদ্ধ নাম, আ’শুরা হলো মুর্হরমের দশম তারিখ আর তাসূয়া’ হলো- নবম তারিখ।” (কাশ্শাফুল ক্বান্না ২/১৮)
আশূরা’র নামকরণের বিষয়ে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মত পোষণ করেন। তবে অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম বলেন, এ দিনটি মুহররম মাসের ১০ তারিখ বলেই এটার নাম ‘আশূরা’ হয়েছে।
কোন কোন আলেম বলেন, আল্লাহ পাক উম্মতকে যে দশটি বুযূর্গ ও সম্মানিত দিন উপহার দিয়েছেন, তন্মধ্যে আশূরার দিনটি ১০ম স্থানীয়। এ কারণেই এটির নাম ‘আশূরা’ রাখা হয়েছে। আবার কারো মতে, এই দিনটিতে যেহেতু আল্লাহ পাক স্বীয় দশজন নবীকে ১০টি ভিন্ন ভিন্ন রহমত ও নেয়ামত দান করেছিলেন তাই এটির নাম আশূরা।
আশূরার দিনের বরকতময় ঘটনাসমূহ :
সৃষ্টির সূচনা হয় এই দিনে এবং সৃষ্টির সমাপ্তিও ঘটবে এ দিনেই। বিশেষ বিশেষ সৃষ্টি এ দিনেই করা হয়েছে এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনা এ দিনেই সংঘটিত হয়েছে।
হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু কওে আমাদের প্রিয়নবী হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রায় সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামের উল্লেখযোগ্য কোনো না কোনো ঘটনা এ দিনে সংঘটিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এ দিনটি সবার জন্য এক মহান আনুষ্ঠানিকতার দিন, সাথে সাথে রহমত, বরকত ও মাগফিরাত হাছিল করার দিনও। এ আশূরার দিনে অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে- যা সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো:
মহান আল্লাহ পাক এই মুহররমের ১০ তারিখে পৃথিবীর সূচনা করেন।
এ দিনে আমাদের প্রিয়নবীর নূর মুবারক অস্তিত্বে আসে।
আশূরার দিন জুমা বার ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।
এ দিনে হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের দোয়া কবুল করা হয়।
এ দিনে হযরত ইদ্রিস আলাইহিস্ সালামকে সম্মানিত স্থানে তথা আকাশে তুলে নেয়া হয়।
এ দিনে হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের আল্লাহ পাক মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি দেন।
আল্লাহ পাক এ দিনে হযরত মূসা আলাইহিস্ সালামের সাথে কথোপকথন বলেন এবং তাঁর উপর তাওরাত নাযিল করেন।
এ দিনে হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম ও তাঁর অনুসারীদের জন্য আল্লাহ পাক সাগরের উপর দিয়ে রাস্তা করে দেন।
এ দিনে হযরত ইউনূস আলাইহিস্ সালামকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দেন।
এ দিনে আল্লাহ তাআলা হযরত আইয়ুব আলাইহিস্ সালামকে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থতা দান করেন।
এ দিনে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর হযরত ইয়াকুব ও হযরত ইউসূফ আলাইহিমাস্ সালামের সাক্ষাত হয়।
এ দিনে হযরত সোলায়মান আলাইহিস্ সালামকে তাঁর রাজত্ব বা কর্তৃত্ব দেয়ার ঘোষণা দেন।
এ দিনে আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামকে আসমানে তুলে নেন।
এ দিনে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বিলাদত, খলীল উপাধি এবং নমরূদের অগ্নিকুÐ থেকে মুক্তিলাভ করেন।
এ দিনে হযরত দাঊদ আলাইহিস সালামের দুয়া কবুল এবং তাঁর পুত্র হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালামের বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এ দিনেই মহান আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম যমীনে বৃষ্টি নাযিল করেন।
এই ১০ই মুহররম আল্লাহ পাকের প্রিয় হাবীব হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তম দৌহিত্র বেহেশেÍর যুবকদের সরদার হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আলে বায়তের অনেক সদস্য কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করে ইসলামকে পুনর্জীবন দান করেন।
সুতরাং এই পবিত্র মুহররম মাসটি সকলের জন্যই রহমত, নি’মত, বরকত ও মাগফিরাত হাছিল করার মাস। সে জন্যই অতীতের সকল ইমাম-মুজতাহিদ ও ওলী আল্লাহ এই পবিত্র মুহররম মাসকে সম্মান করেছেন।
আশূরার আমল :
রোযা : আশূরার অন্যতম ফযীলতপূর্ণ আমল হচ্ছে রোযা; তথা ১০ই মুহররম উপলক্ষে দুটি রোযা রাখা। অর্থাৎ ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ। শুধু ১০ তারিখ রোযা রাখা মাকরূহ। কারণ এ দিন ইহুদীরাও রোযা রাখে। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “তোমরা আশূরা উপলক্ষে রোযা রাখো এবং ইহুদীদের খেলাফ করো। তোমরা আশূরার দিন এবং এর পূর্বে অথবা পরে আরেকটি রোযা রাখো।” অর্থাৎ ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখ রোযা রাখো। (আহমদ-১/২৪১)
এ প্রসঙ্গে বুখারী ও মুসলিম-এ বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় তাশরীফ নিয়ে গেলেন তখন লক্ষ্য করলেন ইহুদীরা আশূরা’র দিন রোযা পালন করছে। তখন তিনি তাদের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেঃ এই দিন আল্লাহ হযরত মুসা আলাইহিস্ সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে মেরেছিলেন। হযরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘটনার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোযা রাখতেন। আর তাই আমরাও রাখি। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেনঃ তোমাদের চেয়ে আমরা হযরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরো বেশি হক্বদার ও নিকটবর্তী। এ বলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশূরা’র এই রোযাগুলো রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী-১৮৬৫)
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “রমাদ্বানের পর সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ রোযা হচ্ছে, মুহররম তথা আশূরার রোযা এবং ফরয নামাযের পর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নামায হলো রাতের নামায বা তাহাজ্জুদ নামায।” (মুসলিম-১৯৮২)
তিনি আরো এরশাদ করেন, “আরাফাহ দিনের রোযা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়। আর আশুরার রোযা বিগত এক বৎসরের গুনাহ মাফ করে দেয়।” (মুসলিম-১১৬২)
আশূরার দিন পরিবারবর্গের জন্য উন্নতমানের খানা-পানির ব্যবস্থা করা : রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আশূরার দিন তার পরিবারবর্গকে ভালো খাদ্য খাওয়াবে ও ভালো পোশাক পরাবে আল্লাহ পাক সারা বছর তাকে সচ্ছলতা দান করবেন।” (শুয়াবুল ঈমান-৩৫১৪, ত্ববরানী: ৯৩০২)
পবিত্র আহলে বাইতকে স্মরণ : ইতিহাসে যতগুলো হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো ৬১ হিজরী সনের ১০ই মুহররমে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনা। সাইয়িদুশ্ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মুবারক শাহাদাত। যাতে রয়েছে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা ও উপদেশ। এ ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়- মুসলমান কোনো বাতিল শক্তির কাছে হার মেনে বশ্যতা শিকার করতে পারে না। মহিলা ও শিশুসহ মাত্র ৭২ জন সঙ্গী নিয়ে কূফার পথে আক্রান্ত হন এক বিশাল বাহিনী দ্বারা। বীর বিক্রমে জিহাদ করে শাহাদাত বরণ করে ইসলামকে পুনর্জীবন দান করেন ও শাহাদাতের মাক্বাম লাভে ধন্য হন। কিন্তু নাহক্বকে স্বীকার করে নেননি।
তাই পবিত্র আশূরার একটি বিশেষ আমল হলো পবিত্র আহলে বাইতদের প্রতি ভালবাসার ইযহার করা। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, “হে আমার হাবীব! আপনি বলে দিন, আমি তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চাই না। তবে আমার নিকটজন তথা পবিত্র আহলে বাইতদের প্রতি তোমরা সদাচরণ করবে।” (সূরা শূরা, আয়াত- ২৩)
রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “হে মহান আল্লাহ! আমি হাসান, হুসাইন এবং তাদের আওলাদগণকে ভালোবাসি। আপনিও তাঁদেরকে ভালোবাসুন এবং যে ব্যক্তি তাঁদেরকে ভালোবাসবে তাদেরকেও আপনি ভালোবাসুন।” (তিরমিযী: হা-৩৭৩১)
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ