এম এ হোসাইন
নগরের প্রতিটি এলাকায় এখন পানি সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বাসিন্দা পানি না পেয়ে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরও মিলছে না প্রয়োজনীয় পানি। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা যখন নাগরিক দুর্ভোগ লাঘবে দিনরাত পরিশ্রম করার কথা, তখন তারা ব্যস্ত ভ্রমণ পরিকল্পনায়। ‘কর্মশালা’ নাম দিয়ে পর্যটন শহর কক্সবাজারে তিনদিনের সফরে যাচ্ছেন ওয়াসার ২২ জন কর্মকর্তা। এতে প্রতিষ্ঠানটির অগ্রাধিকার নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
ওয়াসার এমন ভ্রমণ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এখন প্রতিষ্ঠানটির ভেতরেই দেখা দিয়েছে অস্বস্তি। বিশেষ করে মধ্যম ও নি¤œ পর্যায়ের কর্মচারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, সাধারণ গ্রাহকরা যখন পানি না পেয়ে ভোগান্তিতে, তখন শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারি অফিস চলাকালীন সময়েই সমুদ্রপাড়ে আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠবেন, এটা কোন দায়িত্বশীলতা?
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার পাশা এবং উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিষ্ণু কুমার সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
সূত্রে জানা গেছে, ওয়াসার ২২ জন কর্মকর্তা আগামী ১৫ মে বিকাল সাড়ে তিনটায় কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হবেন। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অফিস ছুটি হয় বিকাল ৫টায়। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই অফিস টাইমে গন্তব্যে রওনা দেবেন তারা। আবার ১৭ মে শনিবার অফিস খোলা থাকার কথা থাকলেও সেই দিনটিতেও তারা থাকবেন না অফিসে, থাকবেন কক্সবাজারে। তিনদিনের এই সফরে প্রথম দিন (শুক্রবার) বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং দ্বিতীয় দিন (১৭ মে) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মোট ৭.৫ ঘণ্টা কর্মশালার সময় নির্ধারিত। অথচ হোটেল বুকিং করা হয়েছে তিন দিনের জন্য, রয়েছে বিমান ও গাড়ি ভাড়া, আপ্যায়নের ব্যবস্থাও।
এ প্রসঙ্গে ক্যাব (কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ওয়াসা নিজেদের একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছে। সাবেক এমডি ফজলুল্লাহ চলে গেছেন, কিন্তু তার প্রেতাত্মারা এখনো আছে। কর্মকর্তারা কর্মশালার নামে প্রমোদভ্রমণে ব্যস্ত। ম্যান বদলেছে, কিন্তু সিস্টেম তো আগের মতোই আছে। প্রতিটি প্রকল্প নেয়া হয় কর্মকর্তাদের পকেট ভারি করার জন্য।
এই কর্মশালায় অংশ নিতে যাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রকৌশল) বিষ্ণু কুমার সরকার, বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক কাজী শহিদুল ইসলাম, ম্যাজিস্ট্রেট শিরীন আক্তার, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রুমন দে, তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম, উপসচিব মুহাম্মদ নাজিম উদ্দীন, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আল মেহেদী শওকত আজম, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম, আব্দুর রউফ, আজিজুর রহমান, সিস্টেম এনালিস্ট লুৎফি জাহান, উপ-প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নাজমুন নাহরাইন, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইফতেখার উল্লাহ মামুন, মো. সাহাব উদ্দিন, মো. মনিরুল ইসলাম, রিচার্ড নেলছন পিনারু, জনসংযোগ কর্মকর্তা কাজী নূরজাহান শীলা, সহকারী সচিব মোহাম্মদ বাবুল আলম, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহেল, রাজস্ব কর্মকর্তা এরফানুল করিম সাজ্জাদ, মো. হোসাইন আলী এবং বাজেট অফিসার মু. পারভেজ। তাদের মধ্যে বিষ্ণু কুমার সরকার ও কাজী শহিদুল ইসলাম বিমানযোগে যাবেন, বাকিরা যাবেন হাইস গাড়িতে।
সূত্রমতে, পুরো কর্মশালায় আলোচনার জন্য সময় নির্ধারিত হয়েছে মাত্র সাড়ে সাত ঘণ্টা। অথচ তিন দিনের জন্য হোটেল বুকিং, গাড়ি ও বিমানভাড়া, আপ্যায়নের আয়োজন, সব মিলিয়ে এ আয়োজনের চেহারা একটি বিলাসবহুল ভ্রমণের মতো। কর্মশালার ব্যানারে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ঝুঁকিপূর্ণ স¤প্রদায়ের পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আলোচনার কথা বলা হলেও তা কেবল লোক দেখানো। কারণ কর্মসূচির টাইমলাইন এবং ভেন্যু বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার, মূল উদ্দেশ্য ভ্রমণই।
ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, এই কর্মশালাও অফিসিয়াল কাজ। এটা বিদেশি ফান্ডে হচ্ছে, বিদেশিরাও অংশ নেবে। কক্সবাজারে নিম্নআয়ের মানুষের পানি সরবরাহ নিয়ে নীতিমালা হবে। এটি আনন্দ ভ্রমণ বলা যাবে না।
তবে অফিস চলাকালীন সময়েই সবাই কক্সবাজারে থাকলে গ্রাহক সেবা কিভাবে নিশ্চিত হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শনিবার ছুটির দিন হিসেবেই রাখা হয়েছিল। এখন যেহেতু অফিস খোলা, একটু পজিটিভলি দেখতে হবে।
কয়েকদিন আগেই ৯১ জন কর্মকর্তার জন্য নতুন করে মোবাইল কেনা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে ওয়াসা। এবার সেই সমালোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই এ ‘কর্মশালা’র নামে ভ্রমণের আয়োজন জনমনে আরও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। নাগরিক সেবা কি তবে বিলাসবহুল সফরের ছলে অপচয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে?
চট্টগ্রাম শহরে কেন এই আয়োজন না করে সমুদ্র পাড়ে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়বস্তু যদি গুরুত্ব পেত, তাহলে এটা স্থানীয়ভাবে করা যেত। অফিস চলাকালীন পুরো বিভাগ ফাঁকা রেখে এভাবে কর্মকর্তাদের বেরিয়ে যাওয়া সত্যিই দুঃখজনক।
নগরবাসীর জন্য পানি সরবরাহ এখন রীতিমতো সংগ্রামের নাম। কিন্তু সেই সেবা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা যখন বিলাসী ভ্রমণে ব্যস্ত থাকেন, তখন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। অফিস চলাকালীন সময়েই পুরো দপ্তর ফাঁকা রেখে কক্সবাজারে যাওয়া একটি অনৈতিক উদ্যোগ বলেই মনে করছেন অনেকে।