যীশু সেন
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাবের কারণে আমাদের দেশে ও সমাজে অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে। বিশেষত, তরুণদের মধ্যে এই অপসংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যাহা মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী এবং জাতির অগ্রগতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- সামাজিক ঐতিহ্যের প্রতি অবমাননা করা, অশোভন আচরণ, সহিংসতা, মাদকাসক্তি, দেশদ্রোহী কর্মকান্ড, অশ্লীলতা, দুর্নীতি, অনৈতিক সম্পর্ক, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং নৈতিকতার অবনতির মত ক্ষতিকর প্রবণতাগুলো সমাজের এক অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অপসংস্কৃতির বিপরীতে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা একান্তই প্রয়োজনীয়। সুস্থ সংস্কৃতি কেবলমাত্র সমাজের নৈতিক অবস্থা উন্নত করে না, বরং এটি মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ, ঐতিহ্যের সম্মান এবং আদর্শ জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সুস্থ সংস্কৃতি হলো এমন একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশ যা মানুষের নৈতিক, শারীরিক এবং মানসিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়। এটি সাধারণত ঐতিহ্য, আদর্শ এবং মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সুস্থ সংস্কৃতির মধ্যে থাকে মানবাধিকার, সহনশীলতা, সদাচার, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং পরিবার, সমাজ বা দেশের প্রতি শ্রদ্ধা। এটি মানুষকে সত্য, ন্যায়, সদাচার, দয়া ও সহানুভূতির দিকে পরিচালিত করে।
অপসংস্কৃতি যখন সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা কেবল ব্যক্তি বিশেষের ক্ষতি তা নয় বরং পুরো দেশ ও সমাজের কাঠামো এবং মূল্যবোধের উপর ক্ষতিকর। অপসংস্কৃতির প্রভাব ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক স্থিতিশীলতার উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। দেশের যুবসমাজ অপসংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নৈতিকতার মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়।
অপসংস্কৃতি সমাজে সহিংসতা, সন্ত্রাস এবং অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারে। যখন সমাজের সদস্যরা নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তা দেশ ও সমাজের শান্তি এবং নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অপসংস্কৃতির প্রভাবে মানুষ অনৈতিক কাজের দিকে ধাবিত হতে পারে। তাদের মুখের কথা আর মনের কথা এক হয়না। মিষ্টভাষীর আড়ালে সমাজে বিভিন্ন অপকর্ম ও অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকে। তারা অত্যন্ত ভয়ংকরী, স্বার্থপর, লোভী ও অহংকারী হয়। অনেকে নিজেকে প্রতিভাবান দাবি করে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম তৈরি করে পদে এসে পদবী বিক্রি করে ধর্মব্যবসা করে এবং সমাজ ও দেশের কাজে নিবেদিত না হয়ে রঙিন পোশাক পরে যাজক সেজে ভন্ডামি করে। তারাই সমাজে অপরাধমূলক কর্মকাÐের জন্ম দেয় এবং নৈতিক অবক্ষয় তৈরি করে। যেমন- মাদকাসক্তি, অবৈধ সম্পর্ক, দুর্নীতি, চুরি, পারিবারিক ঝগড়া, বিবাহ-বিচ্ছেদ ইত্যাদি।
সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা শুধুমাত্র ব্যক্তির জন্যই নয় বরং দেশ ও সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা দ্বারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো: সুস্থ সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধের সৃষ্টি করে। আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবকে দূরে ঠেলে এটি মানুষকে দায়িত্বশীল, সম্মানজনক এবং সহানুভূতিশীল হতে শিখায়। এর ফলে, সমাজে সহমর্মিতা এবং শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পায়। মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এতে যোগব্যায়াম, নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, সময়মত বিশ্রাম এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য ধ্যানের মতো অভ্যাস গড়ে ওঠে, যা মানুষকে সুস্থ রাখে।
সুস্থ সংস্কৃতির মাধ্যমে সমাজের মধ্যে ঐক্যমত্যের সৃষ্টি হয়। মানুষ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে এবং সামাজিক অস্থিরতা কমে যায়। পরিবার, সমাজ এবং জাতির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। পরিবারের মধ্যে ভালোবাসা, সম্মান এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে তোলে। এটি সামাজিক সম্পর্ক ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন সৃষ্টি করে, যা দেশে ও সমাজের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার উপায় অপসংস্কৃতি রোধে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা প্রয়োজনীয়, তবে এর জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কৃতির শিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
পরিবার হলো সমাজের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাবা-মা এবং অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, সততা এবং সহানুভূতির মতো গুণাবলী গড়ে তোলা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি অপসংস্কৃতির প্রসারের আশঙ্কা থাকলেও এই মাধ্যম ব্যবহার করে সুস্থ সংস্কৃতির প্রচার করা সম্ভব। বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে সুস্থ সংস্কৃতি প্রচারে উদ্যোগী হতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ যেমন- সংগীত, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্য, চিত্রকলা, সাহিত্য চর্চা ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে সমাজে সুস্থ সংস্কৃতির প্রচলন করা যেতে পারে। এসব অনুষ্ঠানে মানুষের মধ্যে জাতিগত ঐতিহ্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বৃদ্ধি পায়। সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের উচিত সুস্থ সংস্কৃতি প্রচারের পাশাপাশি অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধেও আওয়াজ তোলা। এটি জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। অপসংস্কৃতি সমাজে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে আমরা এর প্রতিরোধ করতে পারি। সুস্থ সংস্কৃতি আমাদের নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে, আমাদের দেশ ও সমাজকে উন্নতির পথে পরিচালিত করে এবং মানুষের মধ্যে মানবিকতা, শান্তি ও সহানুভূতির চর্চা গড়ে তোলে। সুতরাং অপসংস্কৃতি রোধে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা অত্যন্ত অপরিহার্য এবং এটি দেশ, সমাজের উন্নয়ন ও সাফল্যের পথে কার্যকরী পদক্ষেপ।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক