নিষ্ঠুরতার সমস্ত পারদ ভেঙ্গে এখন একেকটি অপরাধ চিত্র যেন জাহেলিয়াতের নিশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড, বর্বর হামলা, সংঘাত-সংঘর্ষ ইত্যাদি নতুন না হলেও সমকালীন অপরাধ প্রবণতার ধরনের যোগ হয়েছে,‘মব সন্ত্রাস’। এ মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে শত শত মানুষ হতাহতের শিকার হয়েছে, যে তালিকায় মসজিদের ইমাম, বিদূষী নারী, গৃহিণী, শিক্ষার্থী, রাজনীতিক, সংস্কৃতি কর্মী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি পেশার লোকজন রয়েছে। একটি পরিবর্তীতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্দলীয় সরকারের অধিনে বাংলাদেশে এমন অপরাধপ্রবনতা অতীতে আর কখনো দেখা যায় নি। এ যেন বডি আছে অথচ শরীরের কোন অঙ্গ সতেজ নয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিকতাপূর্ণ তৎপরতাও এখন তেমন দৃশ্যমান নয়। সারা দেশের অপরাধ চিত্র পর্যালোচনা করলে উপরোক্ত কথাগুলোই যথার্থ মনে হবে। আমরা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কথাই বলছি। সম্প্রতি বেশকিছু খুনাখুনির ঘটনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এ নগরীতে গত ছয় মাসে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাংয়ের অপহরণের মতো অপরাধ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। পুলিশের হিসেবেই আগের চেয়ে অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া এলাকা ভিত্তিক সন্ত্রাসীদের আধিপত্যের লড়াইয়ে আতঙ্কিত নগরবাসী। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের দাবি, পুলিশি তৎপরতা কমায় চট্টগ্রামে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। গত মঙ্গলবার বাকলিয়ায় অন্তঃদলীয় সংঘাতে প্রকাশ্যে গুলি করে একজন যুবদল কর্মীকে হত্যার ঘটনায় নতুনভাবে আলোচনায় আসে চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এর আগে বাকলিয়া এক্সেস রোডে আরো একাধিক খুন-খারাবির ঘটনা ঘটেছে। বন্দর, পাহাড়তলী, আকবর শাহ, বায়েজিদ, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ এলাকায় রাজনৈতিক বিরোধ, কিশোর গ্যাং, ছিনতাই-রাহাজানিসহ নানা অপরাধ প্রবনতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে। অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, বছরের শেষ ছয়মাসে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে ১১৮টি, যা গত বছরের একই সময়ে তুলনায় ৩৪টি বেশি। এসবের মধ্যে বেশি ঘটেছে খুন ও অপহরণের ঘটনা।
এছাড়া দিনেদুপুরে ছিনতাই ও অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও হুমকির মতো ঘটনা চিন্তায় ফেলেছে নগরবাসীকে। তাদের অভিযোগ আগে ফাঁড়ি ও থানার টহল পুলিশের জোরালো কার্যক্রম ছিল। কিন্তু সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশের কর্ম তৎপরতা এখনো পুরোদমে দেখা যাচ্ছে না। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণে আসছে না, যার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অ্যাপভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলছেন, ‘পুলিশ ধরতে পারছে না আসামিদের, এটা তো আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। জনগণের সাহায্যে হোক কিংবা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হোক, এসব অপরাধীকে ধরা কিন্তু পুলিশের কাছে কোনো ব্যাপার না। এমন বাস্তবায়তায় ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলছে নগর পুলিশ। দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কথাও বলছে তারা। উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৬টি থানা। এই বিশাল এলাকার জন্য পুলিশ সদস্য রয়েছে প্রায় ৭ হাজার। এ চিত্র শুধু চট্টগ্রামের নয়, সারা দেশের। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১১ জন মানুষ খুন হচ্ছেন। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অস্বস্তি বিরাজ করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। অপরাধীদের ভয়ে এগিয়ে আসছেন না সাধারণ জনগণও। এতে জনমনে তৈরি হওয়া উদ্বেগ ও ক্ষোভ দুটোরই প্রকাশ দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
জানা যায়, সারা দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া খুনের মামলার তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধ পরিসংখ্যান তৈরি করে পুলিশ সদর দপ্তর। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে খুন হন ২৯৪ জন। ফেব্রæয়ারিতে খুনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০। পরের মাসে খুনের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। মার্চে সারা দেশে ৩১৬ জন খুন হয়েছেন। এপ্রিলে ৩৩৬ জন, মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন। জুনে চলতি বছরের সর্বোচ্চ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে সারা দেশে মোট ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন।
খুনের পাশাপাশি সারা দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের মতো অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য এক সদস্য। তিনি একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা যে অর্জনটা করেছিলাম তার মধ্যে এখন একটা পলিটিক্যাল দুর্বৃত্তায়ন ঢুকে গেছে। এ উত্তাপেই মূলত এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ ধরনের সংকট নিরসনে সরকারকে কঠোর হতে হবে। দলমত নির্বিশেষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। এছাড়া দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না।’ আমরা মনে করি, সামনে নির্বাচন, এসময়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবশ্যই সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। সুতরাং জনআকাক্সক্ষা পূরণে সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব কঠোর হতে হবে।











