নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) পেতে নতুন করে আবারও তৎপরতা শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করে কড়াকড়ি আরোপ করায় বাইরের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ভোটার হতে চাইছেন রোহিঙ্গারা। গত দশ দিনে শরিয়তপুর ও নীলফামারিতে ভোটার হতে গিয়ে ছয়জন রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার হওয়ার পর তা নিয়ে টনক নড়েছে ইসির। নীলফামারিতে রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে সহযোগিতায় করায় চট্টগ্রামের নুর মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি আলোচনায় এসেছে। ইতোমধ্যে দেশের জেলা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসে রোহিঙ্গাদের এনআইডি সংগ্রহের তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সতর্কতাও জারি করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ শাখার সহকারী পরিচালক মো. আশাদুল হক জানান, দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলার নির্বাচন অফিসে রোহিঙ্গাদের এনআইডি সংগ্রহের চেষ্টার কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের নাগরিক না হলে তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুযোগ না থাকলে বাংলাদেশের কিছু অসাধু ব্যক্তি বা দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের ভোটার বানানোর কাজে সহায়তা করছে। যেটি ২০০৯ সালের ভোটার তালিকা আইন এবং ২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, অনুযায়ী দন্ডনীয় অপরাধ। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে কেউ সহযোগিতা করছে এমন তথ্য থাকলে তা কমিশনকে জানানোর অনুরোধ জানান তিনি।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে সেজন্য বিশেষ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকায় ভোটার হওয়া অনেক কঠিন। যে কারনে অনেকেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিকল্প হিসেবে এনআইডি জালিয়াতি চক্রের সহযোগিতায় অন্য জেলায় গিয়ে ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকেই ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করছে। কেউ কেউ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে জন্ম নিবন্ধন এবং জাতীয়তা সনদ নিয়ে এনআইডি আবেদন করছে। এনআইডি পেলেই পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
জানা যায়, গত ২৬ নভেম্বর নীলফামারী সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ভোটার হতে গিয়ে চার রোহিঙ্গা যুবক গ্রেপ্তার হন। আটককৃত রোহিঙ্গারা উখিয়ার জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্প সাব ব্লক-এফ/১৫, কুতুবপালং ক্যাম্পের ব্লক-জি/২, বালুখালী ক্যাম্পের ৮-ই ব্লক বি/২৭ এর বাসিন্দা। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা হয়েছে। গত ১৯ নভেম্বর শরিয়তপুর গোসাইরঘাটে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ভোটার হতে গিয়ে আটক হন দুই রোহিঙ্গা তরুণ। এসময় তাদের সহায়তাকারী এক দালালকেও আটক করা হয়েছে।
গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবু দাউদ বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র করার জন্য দুই তরুণ ও এক ব্যক্তি আসেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য জমা দেয়া কাগজপত্র দেখে আমার সন্দেহ হয়। তখন তাদের নানা ধরনের প্রশ্ন শুরু করি। তখন তারা ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারছিল না। ভাষাগতি সমস্যাও দেখতে পাই। একপর্যায়ে তারা টেকনাফের দুটি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা হতে গোসাইরহাট এসেছে বলে স্বীকার করেন। তাদেরকে থানায় সোপর্দ করা হয়।
নীলফামারী সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সামসুল আযম বলেন, ‘এরা ভুয়া জন্ম নিবন্ধন ও পিতা মাতার ভুয়া পরিচয় পত্র নিয়ে এখানকার একটি ইউনিয়নের ভোটার হতে আবেদন করেন। এরা প্রত্যেকেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলায় আমার সন্দেহ হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা রোহিঙ্গা নাগরিক ও উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা বলে স্বীকার করেছে। চট্টগ্রামের নূর মোহাম্মদ ও এখানকার দক্ষিণ পঞ্চপুকুর গ্রামের সাদেকুল ইসলামের মাধ্যমে ভোটার হতে চেয়েছিল।’
এদিকে নীলফামারী সদর নির্বাচন অফিসে আটক হওয়া রোহিঙ্গাদের তথ্যে চট্টগ্রামের নূর মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তির নাম উঠে আসার পর আবারো চট্টগ্রামের এনআইডি জালিয়াতি আলোচনায় আসে। চট্টগ্রামের এই নূর মোহাম্মদ কে? তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের কর্মচারীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, নীলফামারীতে রোহিঙ্গা আটকের ঘটনায় চট্টগ্রামের নুর মোহাম্মদ নামে একজনের নাম আসার বিষয়টি জানাজানি হলে তা নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। অতীতে জেলা নির্বাচন অফিসে নুর আহমদ নামে একজন কর্মচারী ছিল। তার বিরুদ্ধে আগে এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। বর্তমানে তিনি হাটহাজারী নির্বাচন অফিসে কর্মরত। নীলফামারীতে গ্রেপ্তার হওয়া রোহিঙ্গারা এই নুর আহমদের কথা বলেছে কিনা নিশ্চিত নয়। এছাড়াও নূর আহমদ ও নূর মোহাম্মদের মধ্যে নামের গড়মিল আছে। এরপরেও যেহেতু গ্রেপ্তারকৃত রোহিঙ্গাদের সেখানে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে পুলিশী তদন্তে বের হবে আসলে চট্টগ্রামের কোন নূর মোহাম্মদ এনআইডি জালিয়াতির সাথে তাদেরকে সহযোগিতা করেছিল। এরপরেই সবকিছু খোলাসা হবে।
এর আগে ২০১৯ সালে হাটহাজারীর ঠিকানা ব্যবহার করে লাকী আক্তার নামে এক রোহিঙ্গা নারী ভোটার হতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের অসাধু কর্মচারীদের একটি চক্রের রোহিঙ্গাদের ভোটার জালিয়াতিতে সহযোগিতা করছেন এমন তথ্য উঠে আসে। সেসময় বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে বড় ধরনের ভোটার জালিয়াতি চক্রের সন্ধান মিলে। নির্বাচন অফিস ও পুলিশে তদন্তে নির্বাচন অফিসের কর্মচারীরা ভোটার জালিয়াতির সাথে জড়িত থাকার সত্যতা মিললে নির্বাচন অফিসের বেশ কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে জামিনে এসে অনেকেই চাকরিতে বহাল হয়েছেন।