অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রসঙ্গে

1

মো. দিদারুল আলম

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর ৮ আগস্ট একটি অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হয়। দীর্ঘদিনের শাসনের চক্র থেকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে জনগণের মতামত, অংশগ্রহণ ও অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। ইতোমধ্যে সরকার গঠনের তিন মাসেরও বশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে- তবে এখন পর্যন্ত জনসাধারণের প্রত্যাশা ও গৃহীত বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায়, অনেকের মধ্যে প্রশ্ন ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় এ সংস্কারগুলো সত্যিকার অর্থে সফল ও কার্যকর করতে হলে যাদের জন্য এ পরিবর্তন, সেই জনগণের সক্রিয় মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
জনগণ আশা হারাতে চান না। কারণ এবার যদি তারা নিরাশ হন, তবে জনগণের ক্ষমতা, জনবান্ধব সরকার ও জনকল্যাণমুখী দেশগঠনের সুযোগ আবার আসবে কি না, কিংবা কবে আসবে, তা নিয়ে জনমনে গভীর সংশয় রয়েছে। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক সফলতার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি সফল সংস্কারের মূলে থাকে জনগণের কল্যাণ ও তাদের জীবনমান উন্নয়নের উদ্দেশ্য। অন্তর্র্বর্তী সরকারও সেই লক্ষ্যে সমাজের বৈষম্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক অসমতা হ্রাস এবং সুশাসনের ভিত মজবুত করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু সমস্যাটি হলো, এ সংস্কারের উদ্যোগগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ধরন জনগণের সঙ্গে আশানুরূপভাবে সংযুক্ত নয়। অর্থাৎ সংস্কারের প্রধান লক্ষ্যভুক্ত মানুষের মতামত ও তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া সংস্কারের ফল সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণে যেসব বাধা রয়েছে, তা দূর করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, জনগণের মধ্যে শাসনব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা একটি বড় কারণ। যখন পূর্ববর্তী সংস্কার ও উন্নয়নের প্রতিশ্রæতি পূরণ হয় না, তখন মানুষের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়, ফলে তারা নতুন উদ্যোগে সাড়া দিতে চায় না। দ্বিতীয়ত, অনেক মানুষ মনে করেন, তাদের মতামত বা অংশগ্রহণ সরকারের সিদ্ধান্তে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না, ফলে অংশগ্রহণে তাদের আগ্রহ কমে যায়। তৃতীয়ত, গ্রাম ও শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকেরই মতামত-উচ্চশ্রেণি বা প্রভাবশালী মহলে তাদের বিষয়টি অবহেলিত হয়, যা অংশগ্রহণের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করে। এ পরিস্থিতিতে একটি সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার প্রক্রিয়া গড়ে তোলার মাধ্যমে এ জনগোষ্ঠীগুলোকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি, আস্থার পুনর্গঠন ও সবার আওয়াজ শোনার একটি সমান সুযোগ সৃষ্টি করা।
যাদের জন্য সংস্কার, তাদের মতামতও দরকার-এ কথা মাথায় রেখে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সংস্কার উদ্যোগগুলোয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। অনলাইনভিত্তিক অংশগ্রহণ বর্তমান সমাজ কাঠামোয় খুব বেশি কার্যকর পন্থা নয়; অনলাইনে মানুষের মনের কথা প্রকাশ থেকে দূরে থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া অনলাইনে অল্পসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয় নেতা, বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী প্রমুখের মাধ্যমে নানা উপায়ে স্থানীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু অংশগ্রহণ বা মতামত গ্রহণ নয়, সংস্কারে মতামতের প্রতিফলনও নিশ্চিত করতে হবে। সঠিকভাবে অংশগ্রহণমূলক সংস্কার না হলে সেই সংস্কারের প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হওয়া কঠিন এবং জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব আরও বাড়তে পারে। সংস্কারগুলোকে কেবল একটি নীতি পরিবর্তন হিসাবে না দেখে, জনগণের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার একটি সুযোগ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামতের যথাযথ মর্যাদা দিলে, সংস্কারগুলো তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে ও ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধানিক ব্যবস্থা বহুলাংশে ভারসাম্যহীন। প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। অন্যদিকে সরকারকে সর্বব্যাপী ক্ষমতার অধিকারী এবং প্রতিপক্ষকে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত এবং ফ্রান্সে আধা-রাষ্ট্রপতিশাসিত সংবিধানিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল, ভারসাম্যপূর্ণ, উদার, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেছে। জার্মান শাসনব্যবস্থাও ভারসাম্যপূর্ণ এবং স্থিতিশীল। স্বৈরশাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ এবং নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি প্রতিহত করে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর সুগম করতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং নেতৃত্বের মন-মানসিকতায় সংসদীয় অথবা রাষ্ট্রপতি বা আধা-রাষ্ট্রপতিশাসিত সংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার কোনটি অধিক উপযোগিতা নির্ণয় করা প্রয়োজন। অন্যদিকে একক নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যবৃন্দ আইন প্রণয়ন অপেক্ষা স্থানীয় প্রশাসনে হস্তক্ষেপ, প্রতিপত্তি বৃদ্ধি, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থ উপার্জনে অধিক মনোযোগ দেন। নির্বাচনও নানাভাবে কলঙ্কিত। দেশব্যাপী অথবা প্রশাসনিক বিভাগভিত্তিক ভোটারের আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে এই দুঃসহ অবস্থার অবসান কিছুটা হলেও হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে করা যেতে পারে। এটা করা গেলে সবচাইতে ভালো হবে।
সংবিধান এবং প্রচলিত আইনে ব্যাপক সংশোধন ও পরিবর্তন ছাড়া দেশে নিয়মতান্ত্রিক উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা; রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গআইন, বিচার এবং শাসন বিভাগে গুণগত এবং টেকসই সংস্কার; সুশাসন প্রতিষ্ঠা; ঘুষ, দুর্নীতি, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি নির্মূল বৈষম্যহীন সমাজ কায়েম; সুসম উন্নয়ন; ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি অথবা একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার। একই সঙ্গে আরো প্রয়োজন আমলাতন্ত্রে পেশাদারি অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামগত সংস্কার, মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রথা প্রবর্তন। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এত কিছু করা সম্ভব বলে মনে হয় না।
পাশাপাশি এ কথাও ঠিক যে গত ৫৩ বছরের নানা চড়াই-উতরাই, হানাহানি, বৈধ-অবৈধ কর্মকাÐ স্বাধীন বাংলাদেশকে যে দুরবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, সেখান থেকে দেশকে তুলে আনার জন্য রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেশবাসী এই ধারণা করতেই পারেন, যেকোনো রাজনৈতিক দলই খোলা দৃষ্টি নিয়ে সেই সংস্কার করবে না। তাই তাঁদের ভরসা বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার। তাই এই সরকারকে সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে।
কোনো রাজনৈতিক দলের ডাকে গণঅভ্যুত্থান হয়নি। মানুষ রাস্তায় নেমেছে ছাত্র জনতার ডাকে। সুতরাং এখন কিছু রাজনৈতিক দল চাইলেই নির্বাচন দিয়ে দিতে হবে, তা ঠিক না। যতোক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন, বিচার ব্যবস্থা, দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, পুলিশের সংস্কার, দুদকের সংস্কার প্রশাসনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ হবে রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন আসবে না, ততোক্ষণ নির্বাচন দেওয়া মানে রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ হাতছাড়া করা।
স্পষ্টতই বিএনপি সংস্কারকে ভয় পাচ্ছে। তারা ভাবছে- এর মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক শক্তি খর্ব হবে এবং এই ফাঁকে শক্ত বিরোধী পার্টি দাঁড়িয়ে যাবে। অথচ বিএনপির উচিত ছিল সংস্কারকে আরও বেশি সমর্থন করা। তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় যে ব্যবস্থাপনা ভেঙে গেছে, তা মেরামতের ঝক্কি নিতে হবে না তাদের। তারা একটা মসৃণ পথ পাবে। নয়া তরুণদের কর্মসূচি এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচিতে ভয় না পেয়ে বিএনপির উচিত হবে সংস্কার কার্যক্রমে সহযোগিতা করা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক