অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতার আখ্যান

1

জসিম উদ্দিন মনছুরি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসেরও বেশি অতিবাহিত হয়েছে। তাদের প্রধান ¯েøাগান ছিলো সংস্কার প্রক্রিয়া। তরুণ প্রজন্ম ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উপদেষ্টামÐলি দ্বারা গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা কম নয়। সফলতার দিক বলতে গেলে বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন। গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল পুনর্গঠন। পুলিশ বাহিনীর সংস্কার প্রক্রিয়া। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা। গণহত্যার নির্দেশ দাতা ও সহযোগীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন পাঠ্যসূচি প্রণয়ন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুনর্গঠন। নির্বাচন কমিশন গঠন ও ঋণের জালে আবদ্ধ দেশকে রিজার্ভে হাত না দিয়ে ঋণ পরিশোধের প্রচেষ্টা। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে লক্ষ লক্ষ মিথ্যা মামলা দিয়ে বিরোধীদের জোর-জুলুম করে জেলে বন্দি রাখা নিরপরাধীদের বেকসুর খালাস প্রদান ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার উল্লেখযোগ্য।দেশের মানুষ যে আশায় বুক বেঁধেছিলো তার কিদাংশ পূর্ণ হলেও মৌলিক বিষয়গুলি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধগতি নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রতিনিয়ত ভাবাচ্ছে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সরকার এখনো সনাক্ত করতে পারেনি। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা বাজার সিন্ডিকেট করে নিত্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কোণঠাসা করে রেখেছে।
বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে পুলিশ সাধারণ ও নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করতো। এখন কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায়ের খবর চাউর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারি অফিসে এখনো দেদারসে ঘুষ বাণিজ্য চলমান রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিত্যনতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দিলেও দেশকে স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নিয়ে আসতে এখনো সক্ষম হননি। কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগীরা প্রকাশ্য দিবালোকে নিরীহ জনসাধারণ ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে চলছে। সরকারের নড়বড়ে স্বভাবের জন্য যে যার মত অধিকার আদায়ে নামে দেশকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ যদি দীর্ঘায়িত হয়,অন্যদিকে তারা যদি আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করতে না পারে কিংবা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে তাদের প্রতি সাধারণ জনগণের ক্ষোভ বাড়বে। দেশের অধিকাংশ জনগণের প্রত্যাশা ছিলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবে। কালো আইনগুলো প্রত্যাহার কিংবা বন্ধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিবে। জনসাধারণ স্বাধীন ও মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার ফিরে পাবে। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ষোলো বছর জনসাধারণ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। স্বাধীন মত প্রকাশে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার। এসব পরিস্থিতি থেকে জনগণ মুক্তি পেতে চাইছে। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাসেরও বেশি অতিবাহিত হলেও মন্তর গতিতে তাদের সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া। দেশের জনগণ নির্ধারণ করবে তাদের পরবর্তী সরকার‌। যে সরকার হবে জনগণের সরকার; জনসাধারণের কল্যাণে নিয়োজিত সরকার। বিরোধী মতের উপর সরকার নিজেদের মত চাপিয়ে দেবেনা। প্রয়োজনে সংবিধান সংস্কার করে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিবে। কিছু কিছু সংস্কার হলেও অধিকাংশ সংস্কারও সোনার হরিণের মতো রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা সরকার যদি নমনীয় নীতি পরিহার না করে তাহলে তাদের দ্বারা বেশি কিছু আশা করা হবে বোকামি। তারা তিন মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত করলেও লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে পারেননি। সংশ্লিষ্টরা মত দিয়েছেন বাজার দর নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করা। বিচার ব্যবস্থায় যাতে কোন সরকার হস্তক্ষেপ করতে না পারে তাই বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। সরকারের প্রথম কাজ হবে জনগণকে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া। জনগণ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য বিচার ব্যবস্থাকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া। কোন সরকার যাতে সরকারে এসে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য আইনকে নিজের করে না নিতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এই মুহূর্তে দেশের ১৮ কোটি জনগণের প্রত্যাশা ও দাবি হচ্ছে অতি দ্রæততম সময়ে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দুর্নীতিরোধে কঠিনভাবে আইনের প্রয়োগ করা। যাতে কেউ দুর্নীতি করে ভবিষ্যতে রেহাই না পায় । অপরাধ দমনে পুলিশ বাহিনীকে স্বাধীন বাহিনীতে রূপদান করা। বিচার ব্যবস্থা যাতে নিজস্ব গতিতে চলতে পারে সে লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থাকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা। যেনো জনগণের ন্যায় বিচারের পথ সুগম হয়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করতে সক্ষম হয় দেশে বিদেশে তারা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে কোন সরকার ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্য সচেষ্ট হবে না। রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাসে জনগণের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করলেও পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হননি। তাদের সংস্কার এখনো আলো-আঁধারি রয়ে গেছে। এই মুহূর্তে দেশের অধিকাংশ জনসাধারণের দাবি ও প্রত্যাশা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল পরিবেশ থেকে রক্ষা করে সুশাসন ফিরে আনা‌। জনগণ যেন সুখে শান্তিতে স্বাধীনভাবে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ফিরে পায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক