নিজস্ব প্রতিবেদক
রেলওয়ের প্রচলিত কোড ও বিধি বিধানের আলোকে রানিং এলাউন্সসহ পেনশন ও আনুতোষিকের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ। যে কারণে গতকাল রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে সকল রুটে ট্রেন সার্ভিস অচল হয়ে পড়েছে। তবে রাত ১২টার আগে ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে স্টেশন ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো নিরাপদে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। রেলওয়ের ১৬০ বছরের পুরানো আইন না মেনে ২০২১ সালের নভেম্বরে রানিং এলাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে এই আন্দোলন শুরু হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন ধাপে আন্দোলন চললেও দাবি আদায় হয়নি। সর্বশেষ গত ১২জানুয়ারি থেকে নতুন করে আন্দোলণ শুরু করে আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দেয় রানিং স্টাফরা।
গত ২৩ জানুয়ারি মাইলেজ বৈষম্য নিরসন ও নিয়োগপত্রের ১২ এর (ক) ও (খ) শর্ত বাতিলের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় মতামত দিলেও তা পুরোপুরি মেনে নেয়া হয়নি।পাশাপাশি গতকাল সকাল ১১টায় রেল ভবনে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকে বসে সংকট নিরসনে করণীয় নির্ধারনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সে বৈঠক প্রত্যাখান করেছে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ। পূর্ণাঙ্গ দাবি না মানা হলে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষনা দিয়েছেন রানিং স্টাফরা। গতকাল সোমবার সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের রেল স্টেশনে কর্মবিরতির সমর্থনে মিছিল-সমাবেশ শুরু করে রানিং স্টাফরা। সমাবেশে ‘রেলের চাকা ঘুরবে না, রেল গাড়ি চলবে না’এমন স্লোগান দেয় আন্দোলনকারীরা।
গতকাল রাত সাড়ে ১২ টায় বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম বিভাগের আহব্বায়ক মো. মজিবুর রহমান ভুঁইয়া পূর্বদেশকে বলেন,‘রানিং স্টাফদের দাবি না মানায় আমরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছি।সন্ধ্যা থেকেই পাহাড়তলী ও রেল স্টেশনে কর্মসূচির সমর্থনে মিছিল করেছি। ঢাকা কমলাপুর রেল স্টেশনেও কেন্দ্রীয় নেতারা মিছিল সমাবেশ করছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত দাবি আদায় হবে না ততক্ষণ আমরা ট্রেন চালাবো না। পাওনা ও অধিকার বঞ্চিত হয়ে আর ট্রেন চালাতে চাই না। আমরা মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিবদের সাথে অনেক বৈঠক করেছি। আর কোন বৈঠকে বসবো না। এখন দাবি মেনে প্রজ্ঞাপন জারি করে ওয়েবসাইটে দিলেই এক সেকেন্ডের মধ্যে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিব। সোমবার রেল সচিবের ডাকা বৈঠকও আমরা প্রত্যাখান করেছি।’
রানিং স্টাফরা জানায়, ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-কুয়াশা, হরতাল-অবরোধ, করোনা মহামারিসহ সকল দুর্যোগে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ট্রেন চালায় রানিং স্টাফরা। রাতে সব মানুষ যখন ঘুমায়, তখন রানিং স্টাফগন নির্ঘুম ট্রেন পরিচালনা করে যাত্রী ও মালামাল গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। অন্য সকল সরকারি চাকরিজীবি সপ্তাহে দুইদিন করে বছরে ১০৪দিন সাপ্তাহিক বন্ধসহ সকল জাতীয় ছুটি ভোগ করেন এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করেন। অথচ রেলওয়ের রানিং স্টাফগণের কোন সাপ্তাহিক ছুটি নেই, নেই কোন প্রকার জাতীয় দিবসের ছুটি। প্রতিদিন ১২-২০ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। ঈদ, পূজা, বড়দিনসহ যে কোন ধর্মীয় উৎসবে সবাই যখন পরিবার নিয়ে আনন্দ উপভোগ করে তখন রানিং স্টাফগণ ট্রেন চালিয়ে যাত্রীদের স্বপ্ন বাড়ি পৌঁছে দেয়। অথচ সেই রানিং স্টাফদেরকেই অবহেলা করা হচ্ছে।
রানিং কর্মচারীদের রানিং এলাউন্স যা মূল বেতনের অংশ, তা যোগ করে পেনশন নির্ধারণের বিধান ১৬০ বছরেরও বেশি সময় যাবত চলমান। অথচ গত সরকারের আমলে নিজেদের দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় ঢাকতে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর এক পত্রে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের রানিং এলাউন্স কিছু ক্ষেত্রে রহিত ও কিছু ক্ষেত্রে খর্ব করে। যা রেলের কোড ও বিধি বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।রানিং স্টাফদের আন্দোলনের মুখে ২০২২ সালের ২৪জানুয়ারি রেলওয়ে সংস্থাপন কোডের বিধান অনুযায়ী রানিং এলাউন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু রানিং এলাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল আবারও অনাপত্তি দিলে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে আন্দোলনে নামে রানিং স্টাফরা। পরবর্তীতে আদেশ প্রত্যাহার করে রানিং এলাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদান করার কথা থাকলেও আগের অসম্মতি প্রত্যাহার হয়নি মর্মে জটিলতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। লিখিতভাবে কোন পত্র জারি না করায় রানিং স্টাফরা হতাশায় ভুগছেন। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর ও ৯ ডিসেম্বর দুই দফা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে এই জটিলতা নিরসন করার কথা বললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। যে কারণে পুনরায় আন্দোলনে নামে রানিং স্টাফরা।
চলতি মাসে আবার আন্দোলন শুরু হলে আংশিক দাবি মেনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেয়া মতামতে বলা হয়, রানিং স্টাফ হিসেবে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভ্রমণ ভাতা বা দৈনিক ভাতার পরিবর্তে রেলওয়ে কোডের বিধান অনুযায়ী রানিং এলাউন্স প্রাপ্য হবেন। চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের জন্য রানিং এলাউন্স ছাড়া অন্যকোন ভাতা প্রাপ্য হবেন না এবং মাসিক রানিং এলাউন্সের পরিমাণ প্রাপ্য মূলবেতনের চেয়ে বেশি হবে না।
রেলওয়ের একজন ট্রেন চালক বলেন, একটি দাবি নিয়েই রেল মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় চার বছর ধরেই গড়িমসি করছে। চলমান একটি প্রক্রিয়াকে হঠাৎ করে বাধাগ্রস্ত করে রেলে অস্থিরতা বাড়ানো হয়েছে। বিগত সরকার এ কাজটি করে রানিং স্টাফদের কাছে বিতর্কিত হয়েছে। এখন বর্তমান সরকারও বিগত সরকারের মতো আচরণ করে আমাদেরকে ন্যায্য প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করছে। দীর্ঘদিন চাকরি করার পরেও নায্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় লোকো রানিং স্টাফ, গার্ড, টিটিইরা চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে যোগ দিচ্ছে।