দেশে ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে অনলাইন জুয়া তথা ক্যাসিনো। যার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে তরুণ ও যুব সমাজের বড় একটি অংশ। এতে এসব তরুণ ও যুব সমাজের আগামীর ভবিষ্যত বিপন্ন হওয়ার বড় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানা যায়, ২০১৯ সালে দেশে ক্যাসিনো নামে একধরনের জুয়া সংস্কৃতি আলোচনায় আসে, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজধানীর বেশ কয়েকটি অবৈধ ক্যাসিনোয় অভিযান চালায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরসমূহে বেশ কিছু অভিজাত ক্লাবে প্রভাবশালী লোকের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব ক্যাসিনো চলত। তাদের অনেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর এসব ক্যাসিনো জুয়া অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। অপলাইনে ক্যাসিনো বন্ধ হওয়ার কিছুদিন পর দেখা যায়, স্মার্ট মোবাইল ফোনে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন ক্যাসিনো চালু হয়ে যায়। বলা প্রয়োজন, জুয়া বা ক্যাসিনো সেই অপলাইন বা অনলাইনে যাই হোক দেশের আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু অনলাইনে এ নিষিদ্ধ ক্যাসিনো চলে আসার পর আমাদের তরুণ ও যুবকদের বড় একটি অংশ অতি লোভে ঝুঁকে পড়ছে এ খেলার প্রতি। বিশেষ করে, গত কয়েক বছরে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমগুলোতে ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন বেড়ে যাওয়ায় তরুণদের মধ্যে এটি আরও জনপ্রিয় হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দৈনিক পুর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), থ্রেড, ইন্সটাগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও মাধ্যমে কম পুঁজিতে কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে শিক্ষার্থী, তরুণ ও বেকার যুবকদের আকৃষ্ট করছে একটি প্রতারক চক্র। শুধু তাই নয়, দেশের বড় বড় সেলিব্রিটিদের ছবি ব্যবহার করেও প্রতারণা করে চক্রটি। এতে একদিকে টাকা ও অন্যদিকে খেলার নেশায় আসক্ত হওয়ায় নষ্ট হচ্ছে তরুণদের ভবিষ্যত। ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে যুবসমাজ। অচিরেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কোন কোন অ্যাপসে এ আই ব্যবহার করে প্রধান উপদেষ্টার ছবি ও বক্তব্য যুক্ত করে ক্যাসিনোতে আকৃষ্ট করছে তরুণদের।
নিষিদ্ধ ক্যাসিনোর ভয়াবহ বিস্তারের খবর সরকারের বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা না জানার কথা নয়। কিন্তু এর প্রতিরোধ, প্রতিকরের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে অনলাইন ক্যাসিনো বা জুয়া নীরব ঘাতকের মতো তরুণ ও যুব সমাজকে গ্রাস করছে। এক তথ্যে দেখা গেছে, অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ, ফুটবল লীগ নিয়েও জুয়া চলছে। অনেকে ক্রিকেটের বলে বলে চার-ছক্কা হওয়া নিয়ে ছোট থেকে বড় অংকের জুয়া খেলছে। ফুটবলে গোল হওয়া বা কোন দল জিতবে তা নিয়েও জুয়া খেলা হচ্ছে। অনলাইনে আরও নানা ধরনের নিত্যনতুন জুয়ার অ্যাপ প্রতিনিয়তই খোলা হচ্ছে এবং এতে তরুণ সমাজ আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে।
কীভাবে তরুণ সমাজ অনলাইন জুয়ায় মত্ত হচ্ছে, এর যে প্রতিবেদন শুক্রবার দৈনিক পূর্বদেশ প্রকাশ করেছে তা রীতিমত গা শিউরে ওঠার মত। প্রতিবেদনে জুয়ায় নিঃস্ব হওয়া এক ভুক্তভোগী দৈনিক পূর্বদেশকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সম্প্রতি স্নাতক শেষ করে বেকার সময় পার করছি। বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরির জন্য আবেদন করলেও সুবিধাজনক হচ্ছে না। তারপর ফেসবুকে ঢুকে সাকিব আল হাসানের ছবি সম্বলিত ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন। ক্রিকেটের তারকার এমন কথার আশ্বাসে বিশ্বাস করে ফেলি যে এটা একটা বৈধ ক্যাসিনো। যখন সাইট ওপেন করে একাউন্ট খুলি, তখন টাকা ডিপোজিট করতে বলা হয়। আমি প্রথমত এক হাজার টাকা ডিপোজিট করি। বিভিন্ন খেলার অপশন শো হয়, জিতলে টাকাটা ওখানে জমা হয় আর হারলে চলে যায়। সমস্যা হচ্ছে- যখন ক্যাসিনোতে আমি উইথড্রো (টাকা উত্তোলন) করতে যাই, তখনই বাঁধে বিপত্তি। টাকা উইথড্রো করার নাম দিয়ে প্রতারকচক্র এসব টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রথম প্রথম আমাকে লোভ দেখানো হলেও এ পর্যন্ত আমি ১২ হাজার টাকা লস করেছি’। এ ভুক্তভোগীর মত হাজারো তরুণ ও যুবক জুয়ার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এরাই হতাশ হয়ে মাদকাসক্ত ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জুয়া ও মাদকাসক্তি সকল অপরাধের উৎস। দুটোই মানুষের মৃত্যুর পথ তৈরি করে। পত্রপত্রিকার খবরে প্রায়ই এই দুই নেশার কারণে খুন, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংসারে অশান্তি সৃষ্টিসহ সংসার ভেঙে যাওয়ার খবরও দেখা যায়। বলাবাহুল্য, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আয় কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। ব্যাংক ও শিল্প কারখানা থেকে ছাটাই এর কারণে অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে গেছে। অতিদারিদ্র্যসীমা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানার উৎপাদনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বলতে গেলে নেই। শেয়ার বাজার যতটুকু ছিল, তাও এখন নেই। এককথায় কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় অর্থ উপার্জনের জন্য বেকার তরুণ সমাজ অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, জুয়া প্রতিরোধ করতে এমন আইন করা দরকার, যা অজামিনযোগ্য। এতে কিছুটা হলেও এর বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। শুধু আইন দিয়ে নয়, অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে এর কুফল সম্পর্কে সর্বত্র জনমত তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।











