নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে ব্রিগেড আকারে গঠিত ‘জেড’ ফোর্সের কমান্ডার, প্রথম পর্যায়ে ১নং সেক্টর (চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী) কমান্ডার, ৭১-এর ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক এবং তারও আগে ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম মহানগরের ২নং গেইটে অস্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছাউনি থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী ৮ম বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান মনে হয় চট্টগ্রামের সঙ্গে কোনো অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। না হলে বারে বারে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ওভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারতেন না। চট্টগ্রাম থেকে তাঁর অভ্যুদয় (২৭ মার্চ ৭১ বেতার বক্তৃতা), চট্টগ্রাম থেকে লয় (৩০ মে ১৯৮০); ৭১-এর ২৭ মার্চের পূর্বে সেনাবাহিনী এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন ছাড়া জিয়ার নাম কেউ জানতো না। পরবর্তী ৯ বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশ তো বটেই, সমগ্র বিশ্ব তাঁর নাম জেনে গিয়েছিলো। ৩০ মে যখন তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেই ফেইটফুল রাতে বিদ্রোহী সেনাদের গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি দেশের এক নম্বর ব্যক্তি।
শুধু যুদ্ধক্ষেত্র নয়, জিয়া যখন রাজনীতিতে অবতীর্ণ হচ্ছেন, তখনও চট্টগ্রামের নাম তার সঙ্গে গ্রথিত হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নামে যে বিরাট ছাত্র সংগঠনকে আজ আমরা চিনি, তার জন্ম হয়েছিলো চট্টগ্রামে। বর্তমান বিএনপির আগে জিয়া জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল বা জাগদল নামে একটি দল গঠন করেছিলেন। তারও আঁতুরঘর চট্টগ্রাম। ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই দুটি ঘটনা সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না, এমনকি ইতিহাসেও তার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। এখন আমি জানি, কিন্তু আমিও জানতে পারতাম না, যদি ঘটনাক্রমে বছর পাঁচ ছয় আগে সাবেক বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও খান বাহাদুর আমান আলীর নাতি অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দিনের সঙ্গে আমার ঢাকায় দেখা না হতো এবং তিনিও কথায় কথায় ছাত্রদল ও জাগদলের জন্মের ইতিহাস আমার কাছে প্রকাশ না করতেন। তিনিই এই ঘটনার স্রষ্টা এবং একমাত্র সাক্ষী। ইতিহাসের সূত্রে পেয়ে আমি উৎসাহী হয়ে উঠি এবং তাঁকে চেপে ধরি যাতে তিনি ঐ ঘটনা বিবৃত করেন।
অনেকে বলতে পারেন ছাত্রদল ও জাগদলের জন্মেতিহাস নিয়ে আমার এত আগ্রহ কেন ? আমি তো বিএনপি করি না, সুতরাং বিএনপি’র ইতিহাস আমি কেন খোঁড়াখুঁড়ি করতে চাই। আমি জানি এ প্রশ্ন উঠবে, সেজন্য আমি তৈরিও আছি জবাব দেওয়ার জন্য। আমার কথা হচ্ছে সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে সত্য উদঘাটন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি আমি ইতিহাস চর্চাও করি। ইতিহাসের উপর আমার অনেক কাজ আছে। এখানে একটি ঐতিহাসিক সত্যের অনুসন্ধান পেয়ে সেই সত্য উদঘাটনের জন্য আমি অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দিনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। সেই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই লেখার অবতারণা।
একাত্তর সালে চট্টগ্রাম থেকেই স্বাধীনতা ঘোষণা প্রদান করে তিনি প্রথম সংবাদ শিরোনাম হন এবং চট্টগ্রাম থেকেই বাংলাদেশ রাজনৈতিক দল (বিএনপি) নামে তাঁর নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা করেন। চট্টগ্রাম থেকে জিয়ার সতর্ক রাজনৈতিক অভিযাত্রা, খোদ জেনারেল জিয়ার রাজনীতিকে রূপান্তরের প্রাথমিক পর্বের প্রত্যক্ষদর্শী ও অন্যতম সহযোগী অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দীন। চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরপ্রজন্ম হলেও, তিনি শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। যদিও শিক্ষকতাও এই পরিবারে নতুন নয়। আরিফ মইনুদ্দীনের দাদা বিংশ শতাব্দির প্রথমভাগে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত রাজনীতিক ও সমাজহিতৈষী খান বাহাদুর আমান আলীও প্রথম জীবনে শিক্ষকই ছিলেন। আরিফ মঈনুদ্দীনের পিতা ব্যারিস্টার আনোয়ারুল আজিম ও মাতা তোহফাতুন্নেছা আজিম উভয়ে রাজনীতিবিদ এবং আইন সভার সদস্য (এমএলএ) ছিলেন। মা পরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তথাপি, আরিফ মঈনুদ্দীন রাজনীতির পথে হাঁটতে চাননি। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেই সন্তুষ্ট ছিলেন। জিয়াই তাঁকে রাজনৈতিক আবর্তে টেনে আনেন। কিভাবে তিনি শিক্ষক থেকে রাজনৈতিক নেতা হলেন এবং চট্টগ্রাম থেকে ছাত্রদল, জাগদল ও বিএনপি গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, সে কাহিনী বর্ণনা করতে যেয়ে অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দীন বলেন, “১৯৭৬ সালের, সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসের কোন একদিন কর্ণেল অলি আহমদ তাঁকে বলেন, জিয়াউর রহমান আপনাকে ডেকেছেন। আরিফ মঈনুদ্দীন বলেন-দেশে এখন সামরিক শাসন, তিনি ডিসিএমএলএ ও আর্মি চিফ, কার্যত সরকার ও প্রশাসনের সবচেয়ে বড় কর্তা। আমি নিরীহ অধ্যাপক মানুষ, আমাকে আবার তাঁর কি দরকার। তবে মনে মনে একথাও ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে না হয়ে পারলেন না যে, ডিসিএমএএ বলে কথা। তাঁর ডাকার অর্থ আদেশ। সে আদেশ অমান্য করবে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা। যেই ভাবা সেই কাজ। অলি সাহেবের কথামত জিয়ার সাথে দেখা করার জন্য অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দীন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ভিভিআইপি রেস্ট হাউসে যান। তার আগে কোন্ পোশাকে যাবেন সেই চিন্তায় তাঁকে কম বেগ পেতে হয়নি। তাঁর ছোট ভাই সাফারি পড়তে পছন্দ করতো। তার অনেকগুলি থেকে নিজের গায়ের মাপ মতো একটি বেছে নিয়ে গায়ে দেন তিনি, তারপরেও তার নিচের দিকে ঝুলটা বেশি হচ্ছিল। কোনমতে গুঁজে টুজে দিয়ে সেনানিবাসের গেটে পৌঁছামাত্র কর্তব্যরত একজন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার নাম। তিনি বললেন আরিফ মঈনুদ্দীন। ‘আসুন’ বলে একজন মোটর সাইকেল আরোহী তাঁকে এসকর্ট করে রেস্ট হাউসের একটি রুমে নিয়ে বসানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখেন উল্টো দিকের দরজা খুলে স্বয়ং জিয়া উপস্থিত। তাঁর চোখে ছিলো চির পরিচিত কালো সানগøাস। করমর্দন করতে করতে তিনি তাঁকে বললেন আপনার সাথে আমার আগে কোথাও দেখা হয়েছে, তাই না। আমার ত্বরিৎ জবাব : “ইয়েস স্যার, আই অ্যাম সেকিং হ্যান্ডস টোআইস উইথ য়ু, ওয়ান্স ইন দি চিটাগাং য়ুনিভার্সিটি, এনাদার ইন দি ক্যান্টনমেন্ট”। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান ফজল করিম, প্রবীণ রাজনীতিবিদ আজিজুর রহমান (গোরা আজিজ) এবং এ কে খানের পুত্র জহিরউদ্দিন খান। ফজল করিম সাহেব তাঁকে জহিরউদ্দিন খানের সাথে এই বলে পরিচয় করিয়ে দেন যে, আজিম ব্যারিস্টারের পুত্র অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দীন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। পরিচয়ের পালা শেষ হলে জিয়া তাঁর ভিশন সম্পর্কে তাদেরকে অনেকক্ষণ বোঝালেন, তার মধ্যে মূল কথাগুলি ছিলো : “আমাদের আর কথা নয়, এখন কাজ করতে হবে। দেশ গড়তে হবে। আমাদের ৮ কোটি মানুষ, ১৬ কোটি হাত। এই হাতকে কাজে লাগাতে হবে। এদেশের অফুরন্ত সম্পদ, অনেক সম্ভাবনা। এদেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমী, কষ্ট-সহিষ্ণু”। এরপর সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে আসেন আরিফ মঈনুদ্দীন।
আর একদিন, তাও অলি সাহেবের মাধ্যমে, তিনি জিয়া সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। এবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হবার পর জিয়া সাহেব তাঁকে যুবকদের সংগঠিত করার জন্য চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেছিলেন, যুবকদেরকে সংগঠিত করা কঠিন। কারণ তারা নিজ নিজ কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে, সে তুলনায় ছাত্ররা নিঃস্বার্থ, ত্যাগী এবং সংগঠিত একটি ফোর্স, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা সহজ। তখন জিয়া যে কথাটি বললেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন ছাত্রদেরকে রাজনীতিতে না আনাই ভালো। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, জিয়াউর রহমান প্রথমে ছাত্রদেরকে নিয়ে রাজনীতি করতে চাননি। যদিও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের অনিবার্যতায় তাঁকেও তেতো গিলতে হয়েছিল।
তিনি আরিফ মঈনুদ্দীনকে আরো বলেছিলেন দলমতনির্বিশেষে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। জাতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন সাধন করতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব করতে হবে। চাল উৎপাদন বাড়িয়ে বিদেশে রফতানি করা যায় কি না সে সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে হবে। কোন্ দেশে রফতানির কথা ভাবছেন আপনি, আরিফ মঈনুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন, তাঁর এধরণের প্রশ্নের উত্তরে জিয়া সাহেব বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে’। যুব সমাজকে সংগঠিত করার ওপর আবারও জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের খালগুলি আঁকাবাঁকা, সেগুলি পুনঃখনন করে সোজা করতে হবে। এটা করা সম্ভব হলে বন্যা থেকে যেমন পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, তেমনি সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনও বাড়ানো যাবে”। এরপর সেদিনের মতো তাঁদের বৈঠক শেষ হয়ে যায়।
অলি আহমদকে আরিফ মঈনুদ্দীন মামা বলে সম্বোধন করতেন। তো মামা আর একদিন তাঁকে বলেন, আমরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছি। জিয়া সাহেব আপনাকে ঢাকায় দেখা করতে বলেছেন। আরিফ মঈনুদ্দীন তাঁকে বললেন ‘রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার ব্যাপারে আমার মায়ের অনুমতি নিতে হবে। আমার মা তোহফাতুন্নেছা আজিম আওয়ামী লীগের একজন প্রথম কাতারের প্রবীণ নেত্রী। তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে ৫৪ সালে এমএলএ ও পরে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র হয়ে সামরিক শাসকের সঙ্গে রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে তাঁর মতামত জেনে নেওয়াটা আমার জন্য খুবই জরুরি এবং নৈতিক দায়িত্বও বটে’।
মাকে জিজ্ঞেস করার পর তিনি আরিফ মঈনুদ্দীনকে বলেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি, আওয়ামী লীগে তোমার জায়গা হবে না। কাজেই তুমি জিয়ার সঙ্গে যেতে পার’। তাঁর অনুমতি নিয়ে অলি সাহেবের কথামতো আরিফ মঈনুদ্দীন বঙ্গভবনে যান। সেদিনের বৈঠকে জিয়া সাহেব তাঁকে বলেন, ‘যুব সমাজকে সংগঠিত করার কোন বিকল্প নেই। কারণ আমি দেশে স্বেচ্ছাশ্রমে যে খালকাটা কর্মসূচি চালু করার কথা চিন্তা করেছি, যুব সমাজের সহযোগিতা ছাড়া তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়’। তিনি একটি যুব প্রতিনিধি দল নিয়ে যশোরের উলশী যদুনাথপুর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যাবার প্রস্তাব দেন তাঁকে।
আরিফ মঈনুদ্দীন চট্টগ্রামে ফিরে এসে প্রথমে ছাত্রনেতা ওসমান গণি চৌধুরী (রাউজান থানার গহিরা গ্রামের বিখ্যাত জমিদার কালাচান চৌধুরীর উত্তর পুরুষ), যিনি তখন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র প্রয়াত অধ্যাপক আনোয়ারুল হক কাদেরী, এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী (পরে এমপি), আবুল কালাম (প্রয়াত), মোহাম্মদ শাহজাহান (চকরিয়া, প্রয়াত) ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’র (পরে এমপি, পটিয়া নিবাসী) সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন এবং তাদের কাছে জিয়া সাহেবের প্রস্তাবটা উত্থাপন করে তাদের মতামত জানতে চান। তারা একটি ছাত্র টিম গঠন করে তাঁর সঙ্গে উলশী যদুনাথপুর প্রকল্প পরিদর্শনে যেতে রাজি হন। ওসমান পরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইতিহাস সংসদের সহ-সভাপতি এবং দৈনিক ঈশান-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হন; আনোয়ারুল হক কাদেরী পাস করে প্রথমে শিক্ষকতা ও পরে রাজনীতিতে যোগদান করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, ফজলে করিম চৌধুরী পরবর্তীকালে ইতিহাস সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও রাউজান থেকে উপর্যুপরি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন; আবুল কালাম (পরে কার্স্টম কর্মকর্তা) চট্টগ্রাম সিটি ছাত্রদলের সভাপতি, মোহাম্মদ শাহজাহান কক্সবাজার জেলা ছাত্রদলের আহবায়ক এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের আহবায়ক নির্বাচিত হন।
এই বৈঠকের পর ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় ৩২জন ছাত্র ও ৫জন ছাত্রী নিয়ে আরিফ মঈনুদ্দীন একটি টিম গঠন করেন এবং তাদেরকে প্রথমে ঢাকা হয়ে যশোর যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে রুট পরিবর্তন করে সরাসরি যশোরে যান। সেখানে যশোরের তৎকালীন ডিসি ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, যিনি পরে সচিব ও আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬Ñ২০০১) প্রতিমন্ত্রী হন, তিনি তাদের দলের দেখ্ভাল করেন। তিনি তাদেরকে একটি বø্যাক বোর্ডে ছক এঁকে খাল খনন প্রকল্পের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তিনি এ বিষয়ে তাঁর লেখা একটি বুকলেটও তাদের মাঝে বিলি করেন। তারা সেখানে দু’রাত কাটিয়ে ঢাকা যান জিয়া সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি তখন দেশের প্রেসিডেন্ট, তাঁরা বঙ্গভবনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জিয়া তাদেরকে চা পানে আপ্যায়িত করেন। তিনি খাল-খনন প্রকল্প পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা ও এ সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চান। তিনি ছাত্রদেরকে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে দেশ গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ ও এ কাজে জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করার পরমার্শ দেন। তিনি আরিফ মঈনুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করেন পরবর্তী কর্মসূচি কি হতে পারে। আরিফ মঈনুদ্দিন তাঁর ছাত্র ও পরিদর্শন দলের অন্যতম নেতা ওসমানকে বলার জন্য আহবান জানান। তিনি বলেন, তাদের এই ৩৭জনের দলকে বিভিন্ন টিমে বিভক্ত করে চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি থানায় একটি করে উদ্বুদ্ধকরণ সভা আয়োজনের দায়িত্ব প্রদান করা হোক। জিয়া সাহেব জানতে চান সভার শ্রোতা কোথায় পাওয়া যাবে? প্রেসিডেন্টের এই প্রশ্নের উত্তরে ওসমান বলেন, এখান থেকে বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে ডিসি এবং ডিসির মাধ্যমে এসডিও ও সিওকে সভা অনুষ্ঠানের জন্য নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নিবন্ধিত ক্লাব, স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তি, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষকদের চিঠির মাধ্যমে সভায় উপস্থিত হওয়ার আহবান জানালেই লোক হয়ে যাবে। এসময় প্রেসিডেন্ট ওসমানকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি রাজনীতি করেন নাকি? এ সময় ওসমান তার রাজনৈতিক পরিচয় প্রদান করলে বৈঠকের সেখানেই সমাপ্ত ঘটে। এই বৈঠকের সচিত্র সংবাদ জাতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ ও টেলিভিশনে প্রচার করা হয়েছিল। এটাই ছিলো ছাত্রদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রথম বৈঠক।
এই বৈঠকের কয়েকদিন পরই উলশী যদুনাথপুর প্রকল্প পরিদর্শনকারি ছাত্রদেরকে নিয়ে বিভিন্ন থানায় সভা আয়োজনের জন্য বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি চলে আসে। চিঠি পেয়ে কমিশনার আরিফ মঈনুদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি লালদীঘির উত্তর পূর্ব কোণায় অবস্থিত তাঁর পিতা-পিতামহের বাসভবন ‘হাসান মঞ্জিল’-এ ছাত্রদেরকে নিয়ে নিয়মিত বসার ব্যবস্থা করেন। উক্ত ছাত্র প্রতিনিধি দলকে তিনি তিন ভাগে বিভক্ত করে চট্টগ্রামের প্রত্যেক থানায় সভা করার জন্য সফর কর্মসূচি তৈরি করে দেন। তারা প্রত্যেক জায়গায় ব্যাপক প্রতিনিধিত্বশীল মানুষের অংশগ্রহণে সফল সভা অনুষ্ঠিত করে প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাল-খনন প্রকল্প সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং তাদেরকেও এধরণের কর্মসূচির আয়োজন ও এতে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দের এই সফর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। পরবর্তীকালে সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে তাদের মধ্য থেকেই অধিকাংশ ব্যক্তি মনোনয়ন পান। এরপর আরিফ মঈনুদ্দিনকে প্রায় প্রতি মাসেই প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে বৈঠক করার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করতে হতো।
কর্ণেল অলি আর একদিন তাঁকে বলেন, তারা শীঘ্রই রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছি, আপনি চট্টগ্রামে একটি কেন্দ্রীয় ছাত্র র্যালির আয়োজন করুন, এতে প্রেসিডেন্ট জিয়া উপস্থিত থাকবেন। এরপর আরিফ মঈনুদ্দিন মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে একটি ছাত্র র্যালির আয়োজন করেন এবং পূর্বোক্ত ছাত্র নেতৃবৃন্দকে র্যালি আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব প্রদান করেন। এ পর্যায়ে প্রশ্ন দেখা দেয় কি নামে র্যালি আহবান করা হবে। আরিফ মঈনুদ্দিন অলি সাহেবকে জিজ্ঞেস করার পর তিনি বলেন, যেহেতু আমরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করব, তাই ছাত্র র্যালির আয়োজক সংগঠনের নাম জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল রাখা যেতে পারে। এরপর সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র তৈরির প্রশ্ন উঠলে আরিফ মঈনুদ্দিন আবার অলি সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন। তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাজমুল আহসান মল্লিকের সাথে আরিফ মঈনুদ্দিনের যোগাযোগ করিয়ে দেন। মল্লিক ছাত্রদলের ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র ও পতাকা তৈরি করে দেন। র্যালির জন্য আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর সময় প্রেসিডেন্ট জিয়ার নাম প্রধান অতিথি হিসেবে দিতে চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে বলেন, ‘আমি ইউনিফর্ম পরিধানরত অবস্থায় ছাত্রদের অনুষ্ঠানে যেতে পারি না। আই উইল সেন্ড ভাইস প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সাত্তার’। অতঃপর বিচারপতি সাত্তারের নামে কার্ড ছাপা হয়। নির্ধারিত দিনে আরিফ মঈনুদ্দিন মুসলিম হলে গিয়ে দেখেন হল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে মাঠে তিল ধারণের স্থান নেই। বিচারপতি সাত্তার শ্বেত কপোত উড়িয়ে এবং জাতীয় ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে র্যালির উদ্বোধন করেন। র্যালিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নামে দেশে একটি নতুন ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। একই সঙ্গে এই সংগঠনের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র বিলি করা হয়। এভাবেই সেদিন চট্টগ্রাম এক নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলো। দেশে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি নামে যে রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তার সূচনা হিসেবে চট্টগ্রামের এই ছাত্রর্যালিকে বিবেচনা করা যেতে পারে।
র্যালিতে জনাব ওসমান গণি চৌধুরীকে আহবায়ক করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদল, জনাব আবুল কালামকে আহবায়ক করে চট্টগ্রাম সিটি ছাত্রদল, জনাব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে আহবায়ক করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদল এবং জনাব মোহাম্মদ শাহজাহানকে আহবায়ক করে কক্সবাজার জেলা ছাত্রদলের আহবায়ক কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রামে নয়া ছাত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশের আশাতীত সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অলি সাহেব আরেকদিন আরিফ মঈনুদ্দিনকে বলেন, মামা আপনাকে মাসখানেকের জন্য ঢাকা যেতে হবে। জিয়া সাহেব চান এবার আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করুন এবং সেখানাকার ছাত্রদের মাঝে নতুন রাজনীতি ছড়িয়ে দিন। আরিফ মঈনুদ্দিন মনে মনে ভাবলেন, “ভালো তো মুস্কিলে পড়া গেল” “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের অনুপ্রবেশ এবং চট্টগ্রাম বিজয়ের পর এখন আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলের ফরমায়েশ, ঠ্যালা সামলাও। চট্টগ্রাম তাঁর নিজের শহর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরিফ মঈনুদ্দিন অধ্যাপনা করেন, সেখানে তাঁর ছাত্ররা আছে। তাই চট্টগ্রামে কাজটা যত সহজে সারা গেছে, ঢাকায় তত সহজ নাও হতে পারে। ঢাকার তিনি কিইবা চেনেন বা জানেন”। কিন্তু অলি সাহেবকে সেসব বলে লাভ নেই, তিনি নাছোড়বান্দা। অগত্যা, নিরুপায় হয়ে ভাবতে লাগলেন, কি করা যায়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ভাগিনা শাহরিয়ারের কথা। শাহরিয়ার তাঁর বড় বোনের ছেলে। তার পিতা, আরিফ মঈনুদ্দিনের ভগ্নিপতি বরিশালের মেজর আফসাউদ্দিন ছিলেন আবার জিয়াভক্ত। আর শাহরিয়ার হচ্ছে ঢাকার ত্রাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঘোষিত সম্রাট আওরঙ্গের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হাতের কাছেই যখন একটা সমাধানসূত্র পেয়ে গেলেন, তখন আর দেরি না করে ঢাকা রওনা হয়ে যান।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা