আবু মোশাররফ রাসেল
চট্টগ্রাম শহরে গত দুইদিন ধরে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার রাতে টানা প্রায় ৩ ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি ঝরেছে নগরজুড়ে। আবহাওয়া অফিসের রেকর্ডে ৪৮ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টি হয়েছে ২৩৪ মিলিমিটার। মিলিমিটারের হিসাবের সাথে বাস্তবতা কী সেটা সবার বুঝে উঠার কথা নয়। তাই বলছি, চট্টগ্রামের আবহাওয়ার গত ২০ বছরের রেকর্ডে দেখা গেছেÑশহরে বৃষ্টিপাত টানা এক ঘণ্টা কিংবা ১২০ মিলিমিটার অতিক্রম করলেই ‘হাঁটু থেকে কোমর সমান’ পানিতে তলিয়ে গেছে বেশিরভাগ এলাকা।
গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে ১৯২ মিলিমিটার। এতটুকুতে হিসাবটি বুঝে আসছে নিশ্চয় অর্থাৎ এই পরিমাণ বৃষ্টিতে শহর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম টানা অতিভারী বৃষ্টিতেও ‘শহর ডোবেনি’। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দিনভর বৃষ্টি হয়েছে ঠিকই কিন্তু নগরীর সবচয়ে জলাবদ্ধতা প্রবণ এলাকাগুলোতেও পানি জমে থাকেনি, স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করেছেন নগরীর বাসিন্দারা, প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবে ছুটেছে শহরের যানবাহন।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় ভারীবৃষ্টি শুরুর পর টানা যখন বৃষ্টি হচ্ছিল, নগরীর বাসিন্দাদের অনেকের আশঙ্কা ছিল, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো শহর পানির নিচে তলিয়ে যাবে’। কিন্তু ওইদিন রাত ১২টার পর নগরীর জলাবদ্ধতাপ্রবণ বাকলিয়া, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, বাদুরতলা, চকবাজার এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার সড়কগুলোতে কোথাও পানি জমে থাকেনি, খাল-নালাগুলোতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক।
অবশ্য গতকাল ভোরের দিকে কোথাও কোথাও একটু আধটু পানি জমতে দেখা গেছে, তবে তা স্থায়ী হয়নি। খুব দ্রুতই পানি নেমে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম শহর পানির নিচে তলিয়ে যায়, নিচতলার ঘরবাড়ি-দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়ে। শহরের রাস্তাঘাটে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে নগরবাসীর দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এই দুর্ভোগই হয়ে উঠেছিল নগরবাসীর অনিবার্য নিয়তি। কিন্তু স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম নগরীতে জলাবদ্ধতা হয়নি। এর পেছনের কারণ জলাবদ্ধতা নিরসনে মেয়রের নেতৃত্বে সমন্বিতভাবে কাজ করেছে সব সংস্থা। বিশেষ করে ডা. শাহাদাত হোসেন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনকে এক নম্বর এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি প্রতিদিন সরেজমিনে বিভিন্ন খাল-নালা পরিদর্শন করে কোথায় পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় করে তিনি একই সাথে খাল ও নালা পরিষ্কারের জন্য সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগকে শতভাগ সক্রিয় রাখেন। পরিচ্ছন্ন বিভাগে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কারণে কর্মীরাও দায়িত্ব পালনের প্রতি আন্তরিক হন। গত ৬ মাস ধরে ডা. শাহাদাত হোসেন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান-আয়োজনে মেয়র শাহাদাত তার বক্তৃতায় বারবার নগরবাসীকে নালা-নর্দমায় ময়লা-আবর্জনা না ফেলার বিষয়ে সচেতন করেছেন, প্লাস্টিক বর্জ্য-পলিথিন যাথে না ফেলা না হয় সে আহŸান জানিয়েছেন। একই সাথে সরকারের উদ্যোগ ও মেয়রের প্রচেষ্টায় জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগাপ্রকল্পের কাজে গতি আসে। গতি আসে বারাইপাড়া নতুন খাল খনন কাজেও। সম্মিলিতভাবে সবার সমন্বয়ে কাজ চলার কারণে এই প্রথম নগরী ডোবেনি।
নগরীর চকবাজারের কে বি আমান আমি রোডের ফুলতলা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সানাউল্লাহ পূর্বদেশকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর এবারই দেখা গেলো ভারী বৃষ্টির পরও এই এলাকায় পানি উঠেনি। জলাবদ্ধতা নিরসনে চাক্তাইখালের দুই পাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ এবং খাল-নালাগুলো পরিষ্কার করার কারণেই এই সাফল্য। তাছাড়া বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরীর পরিচ্ছন্ন কাজে গতি এসেছে, এখন পরিচ্ছন্ন কর্মীরা নিয়মিতভাবে নালাগুলো পরিষ্কার করছে। আসলে খুব বেশি কিছু করার দরকার হয় না, নিয়মিত নালাগুলো পরিষ্কার করলেও শহরে জলাবদ্ধতা হতো না।’
বাদুরতলা জঙ্গিশাহ মাজার গেট এলাকার ওষুধের দোকানি বিভু দাশ পূর্বদেশকে বলেন, ‘এত বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু বাদুরতলায় পানি উঠেনি, এটা একেবারেই বিস্ময়কর ব্যাপার। কারণ, সামান্য বৃষ্টি হলেই বাদুরতলা পানির নিচে তলিয়ে যেতো, আজ (শুক্রবার) সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু পানি উঠেনি। কিছুদিন আগে এই এলাকার নালাগুলো পরিষ্কার করেছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা, সে কারণে এখানে পানি উঠেনি।’
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ও রাজনীতিবিদ আবু সুফিয়ান পূর্বদেশকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা একটি মানবসৃষ্ট সমস্যা, দক্ষ হাতে ম্যানেজ করতে পারলে শহরে তো জলাবদ্ধতা হওয়ার কোনো কারণ নেই। খাল-নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করলে, কোথায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সেটা খুঁজে বের করে দ্রæত ব্যবস্থা নিলে জলাবদ্ধতা হয় না। অতীতের কোনো মেয়র এই কাজটিই সঠিকভাবে করতে পারেননি। সে কারণে বৃষ্টি হলেই শহর ডুবে যেতো। বর্তমান মেয়র চেষ্টা করছেন নগরীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে, তিনি কাজ করেছেন বলেই আজকের এই সাফল্য। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং এই সাফল্য যাতে ধরে রাখতে পারেন সেজন্য তাকে নিয়মিত মনিটরিংয়ে রাখার জন্য বলবো।’
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন গতকাল রাতে পূর্বদেশকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর নগরীতে জলাবদ্ধতা হয়নি; নিঃসন্দেহে এটি আমাদের সবার জন্য স্বস্তিদায়ক একটি ব্যাপার। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে ও দুর্নাম থেকে চট্টগ্রামের মানুষ মুক্ত হতে চেয়েছিল, তারা হয়তো আজ তার কিছুটা সাফল্য দেখতে পাচ্ছে। এটি আমার একক কোনো কৃতিত্ব নয়, এই কৃতিত্ব সবার।’
তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নগরীকে কীভাবে জলাবদ্ধতামুক্ত করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করেছি। আমার সাথে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সমন্বয় করে কাজ করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস, বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থা। তারা আমাকে সহযোগিতা করেছে, আমি সবাইকে সমন্বয় করেছি, সবাই মিলেই আমরা সফল হয়েছি। এজন্য আমি তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ মেয়র বলেন, ‘সম্মিলিতভাবে ও সমন্বয় করে কাজ করলে যেকোনো বড় সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব, সেটি এর মাধ্যমে প্রমাণিত। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নগরবাসীকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি, যাতে তারা নালায় ময়লা-আবর্জনা না ফেলে, খালে যেন প্লাস্টিক-পলিথিন জাতীয় আবর্জনা না ফেলে, এতেও কিছুটা কাজ হয়েছে। আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তিনি চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি মনিটরিং কমিটি করে দেন, সেখানে ফারুক ই আজম বীর প্রতীকসহ তিনজন উপদেষ্টা কাজ করেছেন, তারাও আমাকে গাইড করেছেন, তাদের নেতৃত্বে-নির্দেশনায় আমি কাজ এগিয়ে নিতে পেরেছি, সেজন্য সরকার ও তিনজন উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
মেয়র বলেন, ‘গত ৬ মাস ধরেই নগরীর খাল ও নালা-নর্দমা পরিষ্কার ও খননের কাজে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। সে কারণে ইতোমধ্যে নগরীর অধিকাংশ খাল ও নালা পরিষ্কার করা হয়েছে। এ কারণে ভারীবৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতার আশঙ্কা খুব একটা নেই। হয়তো পানি কিছুক্ষণ জমে থাকতে পারে, তবে তা স্থায়ী হবে না, ইনশাআল্লাহ।’ এই সাফল্য অব্যাহত রাখতে নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন সিটি মেয়র।
নগরীর ‘জলাবদ্ধতা মুক্তির’ বিষয়ে মূল্যায়ন কি জানতে চাইলে সিনিয়র সাংবাদিক ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিএমইউজে) সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ পূর্বদেশকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা চট্টগ্রাম শহরের দীর্ঘদিনের সমস্যা, তবে খুব বেশি পুরোনো নয়। গত ১০/১৫ বছর আগেও শহরের জলাবদ্ধতা এতটা প্রকট ছিল না, পানি জমলেও রাস্তাঘাট একেবারে তলিয়ে যেতো না। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে মানুষের পরিবেশ বিধ্বংসী-অবিবেচক কর্মকান্ড এত বেড়েছে যে, নালা-খাল দখল তো করেছেই সাথে আবার প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে ছড়াছড়ি হয়েছে। সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় এসব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতে শহর ডুবতো। তবে আশার কথা হলো, বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করছেন এই সংকট থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে, তিনি সরকারি সংস্থা থেকে সিভিল সোসাইটি-সবার সাথে সমন্বয় করে কাজ করছেন, সবাই তাকে সহযোগিতাও করছেন। সে কারণেই ধীরে ধীরে সাফল্য আসছে। এই সাফল্য ধরে রাখা গেলে ভবিষ্যতে হয়তো চট্টগ্রামে আর জলাবদ্ধতা হবে না। এই জন্য আমি মেয়রকে ধন্যবাদ জানাব।’
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এবার বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। গত ৬ মাসে সরকারের তিনজন উপদেষ্টা চট্টগ্রামে এসে অন্তত ৫টি সভা করেন। এসব সভায় নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলোর করণীয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং কাজ শেষ করতে মে মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করে সিটি করপোরেশন, সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড, সিডিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সেবা সংস্থাগুলো।