অতঃপর চট্টগ্রাম ডিসি পার্কে হামলা!

2

মিঞা জামশেদ উদ্দীন

কোথাও যেন স্বস্তি নেই, ঘরে-বাইরে একই অবস্থা বিরাজ করছে। বছরের শুরুতে এ শঙ্কা আরো প্রবল হয়। একেবারে তৃণমূলেও এর প্রভাব পড়ে। নানাভাবে, নানা কৌশলে দখল-বেখল- উচ্ছেদ, হামলা-মামলা চলছে, থেমে নেই দুর্বৃত্তায়নও। এসব ঘটনাবহুল কখন কে-কার ওপর দায় চাপিয়ে বৈতরণী পার হয়, এসব সমীকরণ করাও বড়-ই জটিলকর অবস্থা। তবে এসবের সূত্রপাত বা সংঘটিত ঘটনার ধারণা আমজনতার কাছে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অনুমেয় নয়। যেখানে বাগাবাগা রথী-মহারথী, পন্ডিত ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা পর্যন্ত হিমসিম খেতে হয়। দেখাযায়, ঘটনার সূত্রপাত একটা, ঘটে চলছে আরেকটা। ইতিবাচক থেকে নীতিবাচক। পরক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ। শূন্য থেকে কৌন বনেগা ক্রোড়পতি; এসব জটলা আর রম্যরসের ভাগাভাগিতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে জনপদ।
জানুয়ারি (২০২৫) এর শেষ দিকেকার একটি ছোট্ট ঘটনা। মুনছুর নামের জনৈক এক ব্যক্তি সীতাকুÐের মুরাদপুর মৌজায় একখন্ড জায়গা কিনে ঘর করে। জায়গাটি ছিল কৃষি জমি। সম্ভবত জায়গাটি এ লোকের নয়, তার পিতার নামে। জায়গাতে একটি সেমিপাকা ঘর করে তারা। সেখানে মুনছুরের মা ও এক প্রতিবন্ধী ভাই ও প্রতিবন্ধী ভাইয়ের বৌ বসবাস করে আসছে। মুনছুর থাকে বাড়বকুÐে। অনেকটা আলিসান অবস্থায়। সেখানে তার একটি বহুতল বিল্ডিং আছে। আর প্রতিবন্ধী ভাইটি হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনি-রাজমিস্ত্রীর যোগালি ও দিনমজুরি দিয়ে মা ও স্ত্রীর ভরণপোষণ সহ সংসারের নিত্যকর্ম চালিয়ে আসছে। এরমধ্যে মুনছুর ওই জায়গা থাবা বসিয়েছে। মূলত মুনছুর একজন ভ‚মিধস্যু। মুরাদপুর মৌজার পৈত্রিক ওই জায়গার-আংশিক বিক্র করার জন্য আলাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তির কাছে বায়নাও করেছেন, তা আবার বলেকয়ে বেড়াচ্ছে এলাকায়। এরমধ্যে জায়গাটি পরিমাপ করতে গিয়ে অপর এক ব্যক্তির কৃষি জমিতে সিমানার খুঁটি দিয়ে বসে জোরপূর্বক। কথা হলো, লোকটি ওই জায়গাটি পরিমাপ করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দাগের জায়গায় জবর-দখল চালায়। অনেকটা নিজের ইচ্ছে-মতো খুঁটি পুঁতে অন্যের জমিনে। জমিতে সিম চাষ করেন বর্গা কৃষক রনি। লোকটি কৃষক বনিকেও ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। কেন লোকটি এ ঘটনা ঘটাতে গেলো তার কোন অর্থই খোঁজে পাচ্ছি না ; পরক্ষণে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেল, এটি ছিল তার একটি ফাঁদ। একটি ভ‚মিধস্যু-চক্র এভাবে শান্তিপ্রিয় লোকজনের জায়গায়-জমিতে, প্রথমে এভাবে খুঁটি স্থাপন করে, তারপর গায়ে পড়ে ওই ভ‚মির মালিকের সাথে ফেসাদ বাঁধায়। এরপর শুরু হয় দেনদরবার, সালিশ-বিচার, থানা-কোর্ট। এরপর পেশী শক্তি, হুমকি-ধামকি এবং মাস্তান-ক্যাডার লেলিয়ে দেয়া। রীতিমতো একটি অস্থির অবস্থা গড়ে তুলে। শেষতক ভুমির মালিক যেন নামমূল্যে জায়গাটি বিক্র করতে বাধ্য হয়। অতঃপর ভাগবাটোয়ারা। যাদের জায়গা দখল করার চেষ্টা করে, অর্থাৎ এ জায়গার মালিক আমার ভাগিনা, সাবেক সীতাকুÐ থানা ছাত্র দলের সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন সোহেল। তিনি ৪নং মুরাদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন। ভাগিনা কি পরিমান জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর জায়নাজ আগত মুসল্লীদের উপস্থিতি তা প্রমাণ করে। সীতাকুÐের হাইস্কুলের উপর মাঠে রীতিমতো তিল পরিমাণ জায়গা ছিলো না। শেষতক স্কুলের বারান্দায় ও স্কুলের ছাদে পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াতে হয় জানাজা পড়তে আসা মুসল্লীদের। এটি ছিল সীতাকুÐের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ জানাজা। ওই জানাজা আমি, তাঁর নিকট আত্মীয়-স্বজন এবং তাঁর প্রিয় দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব ও বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা প্রফেসর আসলাম চৌধুরী এফসিএ। জনপ্রিয় এ ছাত্রদল নেতার জায়গা দখল করার এমন দুঃসাহসিকতা-ও দেখাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। আজ সমাজ তাদের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাÐে অতিষ্ঠ। এভাবে তারা আরো একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে ওই এলাকায়। সরকারের খাস জায়গাও দখল করাসহ পানি চলাচলের পথে দেয়ালঘেরা দেয়া এবং প্রতিনিয়ত এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংঘটিত করা। এসবে গ্রামের নিরীহ লোকজন বাদ-প্রতিবাদ করলে তাদের উপর চলে হামলা-মামলা। মুরাদপুরের ওই গ্রামটি একেবারে নৈরাজ্যকর পরিবেশ, অতিতে যেমন ছিল, বর্তমানে আরো প্রবল হয়ে ওঠেছে সন্ত্রাসী চক্রটি। গ্রামের মধ্যে কয়েকজন গডফাদার আছে, তারা ঝুপড়ি মেরে থেকেই কিশোরগ্যাং লেলিয়ে দিয়ে এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষের রাতের ঘুম হারাম করে চলেছে। একসময় উপজেলার সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় গ্রাম ছিল এ গ্রামটি। উপজেলা পরিষদের সন্মুখে গ্রামটির অবস্থান।
সর্বশেষ ডিসি পার্কে হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা ষোলকলা পূর্ণ করছে। চট্টগ্রাম থেকে একটু অদূরে সীতাকুÐে ডিসি পার্কটি স্থাপিত হয়। গত ১লা জানুয়ারি থেকে চলে ফুল উৎসবমেলা, এটি এখন বৃদ্ধি পেয়ে চলতি মাসের মাঝামাঝি অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্ধিত হয়। এ ফুলমেলা চট্টগ্রামে ব্যাপক সাড়া পায়। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী ভীড় জমায় এ পার্কে। বেশ পরিমাণ রাজস্ব আয়ও হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে এ পার্কের যাত্রা শুরু হয়। পরপর দুবার এই ফুলমেলা আয়োজন করে আসছেন চট্টগ্রাম ডিসি- প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সবাই আশাবাদী এ পার্ককে ঘিরে। ইতিমধ্যে এ পার্কে নিয়ে মহা পরিকল্পনাও নেয় প্রশাসন। শিশুদের বিনোদন স্পটসহ চট্টগ্রামের প্রশাসনিক পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে। এরমধ্যে অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে করে পার্কের কাঠামো ও অবকাঠামো স্থাপনা করা হয়। সাথে এ পার্কে পরিদর্শনে আসেন দেশের সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত ঝানুঝানু আমলা-সচিবগণ। বলতে হয়, একসময়ে এটি ছিল মাদকের আঁকড়া। মুলত এটি সমুদ্রের-সিকিস্তির চরাঞ্চল এবং স›দ্বীপ চ্যানেলের উপকণ্ঠে- ফৌজদারহাট এলাকায় অবস্থিত। ভুমিধস্যুরা ওই চর থেকে স্কেভেটর দিয়ে কেটে রাতের আধারে বিক্র দেয় লক্ষ লক্ষ ঘনফুট মাটি। পরবর্তীতে ওই মাটির গর্ত লেকে পরিণত হয়। এখনো ওইস্থানে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত রয়েছে। ওই জায়গার পরিমাণ প্রায় ১৯৪ একর। এ পার্ক লাগোয়া রয়েছে ম্যানগ্রোফ বাগান সবুজ বেষ্টনী। তবে এতসব আয়োজন ও ঢাকঢোল পিটানো হলেও নিরাপত্তাজনিত বেষ্টনী ছিল খুবই দুর্বল। বিশেষ করে ফৌজদারহাট হতে পার্কে যাওয়ার রাস্তাটি অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অসংখ্য স্থাপনাসহ লরি, কভার্ডভ্যান ও ট্রাকের অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। অথচ পার্ক লাগোয়া রয়েছে চট্টগ্রামে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। অনেকটা পুরো জায়গাটা-ই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের। সব মিলেই ঐখানকার পরিবেশ তেমন একটা ভালো না, একা-একা চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রশাসন কেন এসবে নিরব ছিলেন, অথচ প্রতিদিনই তাঁদের আনাগোনা ও গাড়িবহর দাপিয়ে চলা চোখে পড়ার মতো। তারপরও কেন পরিবেশ-পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি। ফলশ্রæতিতে তারই খেসারত ও দৃষ্টান্ত এটি। অতঃপর ৪/২/২৫ইং ঘটে যাওয়া এ ছোট্ট ঘটনা, যা বৃহৎ আকার ধারণ করে। এটি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিছু দুষ্ট লোকজন এ ঘটনা ঘটালেও এলাকার লোকজন প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। তাঁরাও দলবদ্ধ হয়ে ধাওয়া দেয় সন্ত্রাসীদের, না-হয় আরো ব্যাপক হতো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।
তবে দেশের চলমান পরিবেশ-পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে ঠেকেছে। তা দিনেদিনে আরো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনভাবেই দেশের পরিবেশ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ আনা যাচ্ছে না। যার ফলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মেধাবী ছাত্র-যুবকদের। গত ২৪ জানুয়ারী ২০২৫ সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন ২০ বাংলাদেশ যুবক। পরে লিবিয়ায় উপক‚লে উদ্ধার হয় হতভাগ্য ২০ বাংলাদেশির মৃতদেহ। এসকল যুবকদের চিহ্নিত করারও অবস্থা ছিল না, অধিকাংশ মৃতদের পচে-গলে যায়। আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা রেডক্রস ধারণা করছে, গলিত মৃতদেহগুলো অভিবাসী বাংলাদেশি যুবকদের। লাশগুলো লিবিয়ায় উপক‚লে মাটি চাপা দেয়া হয়। লিবিয়ায় প্রবাসীদের তথ্য মতে, ২৪ জানুয়ারি লিবিয়ায় উপক‚ল থেকে ছেড়ে যাওয়া নৌকায় ৪৫ বাংলাদেশী ছিল। তাঁরা ইতালির পাড়ি দিতে গিয়ে এ মর্মান্তিক ঘটনায় শিকার হন। বলুন, আমাদের কি কিছুই করার নেই ; তাঁরা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তবে এখন সময় ও উচিত, দেশে কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেয়া এবং বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা। না হয় এভাবে অকাতরে প্রাণ হারাতে হবে বাংলা মায়ের সন্তানরা।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট