পাঁচ বছর পর পর (পঞ্চবার্ষিকীয়) গৃহকর পুনঃমূল্যায়ন করার আইনগত সুযোগ রয়েছে সিটি করপোরেশনের। সাড়ে তিন বছর আগে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের আমলে পুনঃমূল্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু হলে জনসাধারণের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে স্থাহিতাদেশ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। শর্ত ছিল কর আদায় প্রক্রিয়া ‘অটোমেশন’ করতে পারলেই অনুমোদন মেলবে পঞ্চবার্ষিকীয় পুনঃমূল্যায়নের। সে শর্ত পূরণ না করেই ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাবে গৃহকর পুনঃমূল্যায়নের অনুমোদন চেয়ে দুই দফা পত্র দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।
জবাবে চসিকের হোল্ডিং ট্যাক্স, রেইট নির্ধারণ ও আদায় কার্যক্রম অটোমেশনের বর্তমান অগ্রগতি, ২০১৬-১৭ সনে পুনঃমূল্যায়িত কর আদায়ের কার্যক্রম ম্যানুয়ালি নাকি অটোমেশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে, গৃহকর আদায়ে পুনঃমূল্যায়ন বিষয়ে মাসিক সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ওই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক পত্রে এসব জানতে চাওয়া হয়।
গত বৃহস্পতিবার চসিকের সাধারণ সভায় গৃহকর ইস্যু নিয়ে মেয়র বলেন, ‘নতুন করে গৃহকরের হার বৃদ্ধি হবে না। কর আদায়ের আওতা ও পরিধি বাড়ানো হবে। কোন ভবন যদি দুই তলা থাকা অবস্থায় যে কর দিত এখন যদি তিন তলা, চার তলা বা বহুতল হয়ে যায় তা হলে বর্ধিত অংশের জন্য কর ধার্য কোনভাবে অযৌক্তিক হয় না।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, নাগরিক সেবা প্রদান কার্যক্রম সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, জনবান্ধব এবং অনলাইনে সম্পাদন নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এ ব্যপারে স্থানীয় সরকার বিভাগ হতে বার বার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের অধীনে ৭টি সিটি করপোরেশনের (ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট) হোল্ডিং ট্যাক্স, রেইট নির্ধারণ ও আদায় কার্যক্রম ‘অটোমেশন’ এর মাধ্যমে সম্পন্নের কার্যক্রম চলমান থাকায় এবং অবশিষ্ট ৪টি সিটি কর্পোরেশনে (কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, গাজীপুর) অটোমেশন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে বিধায় প্রথাগত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সকল সিটি কর্পোরেশনের চলমান গৃহকর পুনঃমূল্যায়নের কার্যক্রম এ বিভাগের গত ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখের পত্র সংখ্যা: ৮২৫ এর মাধ্যমে স্থগিত করা হয়। এছাড়া জরুরী ভিত্তিতে অনলাইন ভিত্তিক গৃহকর আদায় চালু করে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করে গৃহকর পুনঃমূল্যায়নের জন্য বলা হয়। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্সের রেইট নির্ধারণ ও আদায় কার্যক্রমের অটোমেশন বাস্তবায়নের কোন পর্যায়ে রয়েছে কোন প্রক্রিয়ায় আদায় করা হবে সে সম্পর্কে বিবেচ্য পত্রে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তাছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর পুনঃমূল্যায়নের বিষয়ে মাসিক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে কি-না সে বিষয়েও অবহিত করা হয়নি বলে মন্তব্য করা হয় পত্রে।
অবশ্য চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, অটোমেশন কার্যক্রম চলমান আছে। অটোমেশন কার্যক্রমের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যেই অনলাইনে পৌরকর আদায় করা যাবে। সর্বশেষ ‘এটিএন এন্ড আর কে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চসিক এক বছরের চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটি অনলাইন ভিত্তিক পৌরকর আদায়ে ভবন মালিকদের ডাটা এন্ট্রির কাজ করছে। ইতোমধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ডাটা এন্ট্রি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ এখনো পৌরকর ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ অটোমেশন হয়নি।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে চট্টগ্রাম’সহ সারা দেশের সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তারা অংশ নেন। ওই বৈঠকে চসিকের কর পুনঃমূল্যায়ন নিয়ে ওই সময় সাধারণ মানুষের আপত্তি ও বিক্ষোভ নিয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তীতে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সারা দেশের পৌরকর কার্যক্রমকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। অটোমেশন কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত যে এসেসমেন্ট করা হয়েছে তা স্থগিত রাখা হবে। এরপর একই বছরের ১০ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের তৎকালীন উপসচিব মো. আবুল ফজল মীর চসিককে চিঠি দেন। ওই পত্রে ‘সিটি কর্পোরেশনের গৃহকরের পুনঃমূল্যায়ন স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। একইসঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে অনলাইন ভিত্তিক অটোমেশন পদ্ধতি চালু করে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ধারা-৮২ অনুযায়ী সরকারের অনুুমোদন নিয়ে গৃহকর পুনঃমূল্যায়ন কার্যক্রমর শুরু করতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রমে যে স্থগিতাদেশ ছিল তা প্রত্যাহারে চসিক থেকে মন্ত্রণালয়ে দুই দফা প্রস্তাব পাঠানো হয়। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রস্তাব এবং গত ৩ জুন দ্বিতীয় প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রথম প্রস্তাব পাঠান চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিত হওয়া পঞ্চবার্ষিকী কর পুনঃমূল্যায়ন এর আলোকে পৌরকর আদায়ের অনুমতি চাওয়া হয়। তবে সেখানে অটোমেশন কার্যক্রম সমাপ্ত না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। বরং তিনি লিখেন, ‘২০১৬-২০১৭ সালে চসিক পুনঃমূল্যায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করলেও কর আদায়ের প্রাক্কালে বিভিন্ন মহলের বিরোধিতার কারণে মন্ত্রণালয় গৃহকর কার্যক্রম পুনঃমূল্যায়ন স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয়। তাই সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।’ সুজনের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ২৫ অক্টোবর সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারও করে নেয় মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত ৩ জুন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের স্বাক্ষরে আরেকটি চিঠি পাঠিয়ে দুটো প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- ব্যক্তি মালিকানাধীন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংয়ের বিপরীতে পঞ্চবার্ষিকী কর পুনঃমূল্যায়নের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে কর আদায়। অথবা স্থগিতকৃত পুনঃমূল্যায়ন বাতিল করে নতুন করে এসেসমেন্ট করা। এ চিঠিতেও অটোমেশন কার্যক্রম সমাপ্ত না হওয়ার তথ্যটি গোপন রাখা হয়।